আজকের শিশু আগামীর দেশ ও জাতি গড়ার রূপকার। তাই দেশ গড়ার কারিগরদের গড়ার প্রত্যয়ে শিশু শিক্ষার সব কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু, বাস্তবে সেটা কতোটা হচ্ছে? প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০২৩ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া সর্বস্তরে চরম অসন্তোষসহ হতাশা বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদের বক্তব্য যথার্থ। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক অংশীজনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকা স্বাভাবিক। প্রত্যেক স্টেক হোল্ডার কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখেন।’
এমন মানসিকতা কারো থাকা কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের অন্যতম উপদেষ্টা ও প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকার সাবেক বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইন্দু ভূষণ দেব বলেন, ‘সকলের প্রত্যাশা তালগাছটা হোক আমার। প্রাথমিক শিক্ষা সব শিক্ষার মূল ভিত্তি। এই প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সবার সম্মিলিত কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নিয়োগবিধিতে ব্যক্তি বা কোনো স্টেক হোল্ডারের স্বার্থ সংরক্ষণ না করে শিশু শিক্ষা সমৃদ্ধ করার বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে।’
প্রাথমিকের নিয়োগবিধির মাধ্যমে শিশু শিক্ষবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলে আগামী দিনে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিষয়ে সুদৃষ্টি দেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দে উন্নত দেশের পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে সচিব, মহাপরিচালক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ শিক্ষা পরিবারের সব সদস্যকে একযোগে এগিয়ে যেতে হবে।
শিশু শিক্ষা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য তৃণমুল পর্যায় থেকে মজবুত নিয়োগ ব্যবস্থাসহ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তৃণমূলে সহকারি শিক্ষক নিয়োগ করে সার্বিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সিনিয়রটির ভিত্তিতে শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে সর্বশিখরে অবস্থান করবেন প্রাথমিক শিক্ষক। মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতাসহ শিশু শিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়ে সমৃদ্ধ হবে শিশু শিক্ষাবান্ধব প্রশাসন।
শিশু শিক্ষার ভিত মজবুত না হলে পরবর্তী শিক্ষার ভিত নড়বড়ে হবে। হাঁস-মুরগি, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার সার্ভিস বিদ্যমান। কিন্তু, প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। বিষয়টি ক্ষোভ ও দুঃখের। ধরা হয়, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাও দক্ষ ও পারদর্শী। তবে তাদের তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের তেমন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নেই। অনেকটা বাবু মাঝি কবিতার সাঁতার না জানা বাবুর মত। পিটিআই ও ইউআরসিগুলো প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ দানের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ সেখানেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাবিহীন জনবল। সর্বস্তরে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি ধরে মেধাবী, অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়োগ দিলে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার হয়ে উঠবে শিশুশিক্ষার স্বর্গরাজ্য। মেধাবীদের পদচারণায় সমৃদ্ধ হবে প্রাথমিক শিক্ষা। তাই, প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হোক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাবিহীন কোনো ক্যাডার কর্মকর্তার মাধ্যমে শিশু শিক্ষা পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
নিয়োগবিধি ২০২৩ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৭৭টি স্টেক হোল্ডারের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ পদোন্নতির বিষয়টি নেই। কোন দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষকদের নিয়োগ পদোন্নতির বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে বোধগম্য নয়। হয়তো প্রাথমিক শিক্ষকেরা সকল শিক্ষিত নাগরিকের শিক্ষক, বিধায় তাঁদের মর্যাদার কথা বিবেচনা করে আলাদা নিয়োগবিধি দেওয়া হবে। তবে সাবেক নিয়োগবিধির আলোকে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি চলমান। তাতে ৮০ শতাংশ সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের/প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। যদিও দীর্ঘ ১ যুগ ধরে এ পদোন্নতি বন্ধ ছিলো। ইদানিং লক্ষ্মীপুর জেলায় পদোন্নতির চাঁদ দেখা গেছে। অন্যান্য জেলায় চাঁদ অমবস্যার কালো ছায়ায় ঢাকা পড়লো কিনা বোধগম্য হচ্ছে না। মেধাবী, অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকেরা দীর্ঘ ১ যুগ পদোন্নতির অপেক্ষায় প্রহর কাটাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা তবুও কেনো প্রশিক্ষণবিহীন ও অনভিজ্ঞ বহিরাগতদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা উন্মুক্ত রেখেছেন? প্রশাসন যদি কোনো সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে পদোন্নতি দেয়, তবে অসন্তোষসহ হইচইয়ের সৃষ্টি হয়। ১৫ থেকে ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ সহকারী শিক্ষকের অনেক ক্ষেত্রে ছাত্র, ছেলে, মেয়ে, নাতি নাতনি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তখন সেই পদোন্নতিবিহীন শিক্ষকের মানসিক অবস্থা কেমন হবে একটু গভীরভাবে উপলব্ধির পরামর্শ রইলো।
শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞদের কর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায়। আমরা দেখেছি, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী ইনসট্রাকটরদের দায়িত্ব থাকে তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষকদের দেখভাল ও প্রশিক্ষণ প্রদান। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষক সি.ইন.এড, ডিপ. ইন. এড, বি.এড, এম.এড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ট্রেইনিং ও অভিজ্ঞতাবিহীন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী ইনসট্রাকটররা তাদের কতোটুকু শেখানোর সামর্থ রাখেন তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
শুধু প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণ করে বয়সের ভার ও অভিজ্ঞতা বেঁধে দেওয়া অযৌক্তিক। উপরস্থ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বয়সে বাঁধা নেই। অবসরের আগের দিনও পদোন্নতির নজির আছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের বয়সের ও অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে পদায়ন ও পদোন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা অমানবিক।
প্রাথমিক শিক্ষকদের পরিচালক পর্যন্ত কাজ করার স্বপ্ন শুধু রূপকথার গল্প। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতি বিধিমালা ঘিরে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। মুখোমুখি অবস্থানে দাড়িয়েছে প্রশাসন ও শিক্ষা ক্যাডার। বিভিন্ন পদে বিভাগীয় পদোন্নতির পরিবর্তে সরাসরি নিয়োগের সুযোগ অবারিত করায় ক্ষুব্ধ প্রাথমিকের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। বয়সসীমা ও সিনিয়রিটি নির্ধারণ এবং বিভিন্ন পদের যোগ্যতা হিসেবে বাধ্যতামূলক বিএড প্রাথমিকের প্রশিক্ষণ একেবারে গুরুত্বহীন করায় প্রাথমিক শিক্ষা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে এ নিয়োগবিধি। সবার মাঝে বদ্ধমূল ধারণা, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন পদগুলো বিলুপ্ত করে, মাঠ পর্যায়ের পদগুলো যাতে প্রশাসন ক্যাডার দখলে নিতে পারে সে উদ্দেশ্যে এ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল কবির চৌধুরী বলেন, বিদ্যমান একটি ক্যাডার সার্ভিসকে ধ্বংসের পায়তারা করছে আরেকটি ক্যাডার। শুধু এখানেই নয়, শিক্ষার সবগুলো জায়গা সবই প্রশাসন ক্যাডার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এতোদিন তারাই দখল করেছিল, এখন তারা স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়া নিজেরাই বিধি বানিয়ে ফেলছেন। আমরা সবাই বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে দ্রুত একটা জোরালো অবস্থানে যাব। শিক্ষার বিভিন্ন পদে নিয়ে দীর্ঘদিন অসন্তোষ বিরাজ করেছিল, প্রাথমিকের শিক্ষক, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে উপপরিচালক পর্যন্ত সব ক্যাডারবিহীন কর্মকর্তারা। প্রশাসন ক্যাডার ও সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কারোই স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার নিয়ে ভাবনা নেই। তাদের সকলের ভাবনা প্রাথমিকের ওপর কর্তৃত্ব করে স্বীয়স্বার্থ হাসিল করা। নতুন বিধিমালার ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন প্রেষণে বদলির মাধ্যমে বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রেষণে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলির মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নিয়োগকারী কতৃপক্ষের এখতিয়ার হওয়ায় মূলত সচিবের হাতেই সম্পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে।
তারা মনে করেন, আইন করে সচিবের হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এই ধারা ব্যবহার করে শিক্ষা ক্যাডারের মাঠপর্যায়ের পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার দখলে নেবে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন বিধিমালার ৯ (১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত ১০ ক্যাটাগরির ৫১২টি পদ ক্যাডার কম্পোজিশন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই পদগুলো নন-ক্যাডারভুক্ত হয়ে গেছে। পদগুলো যখন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত ছিলো, তখন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন নন-ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ক্যাডারভুক্ত পদে পদোন্নতির সুযোগ ছিলো। এই সুযোগ ও মর্যাদা বাতিল হওয়ায় কর্মকর্তারা বিদ্যমান অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবেন।
তারা আরও বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেটেড কর্মকর্তা ও নন-গেজেটেড কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা- ১৯৮৫-তে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারসহ অন্যান্য পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক ছিলো। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ওই নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রি বাদ দেওয়া হলেও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক ছিলো। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা- ২০২৩-এ সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রায় সব পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাদ দেওয়া হয়েছে, যা মানসম্মত শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করার লক্ষ্যে মেধাবী, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের বিকল্প নেই। এ প্রেক্ষাপটে বহিরাগত নিয়োগ বন্ধ করে স্বতন্ত্র প্রাথমিক ক্যাডার সৃষ্টির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদর ও সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম