প্রাথমিকে শিখন ঘাটতি - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে শিখন ঘাটতি

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। তারা বাংলা পড়তে পারেন না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহযোগিতায় এনসিটিবি পরিচালিত এ গবেষণা জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের তাৎক্ষনিক প্রতিবাদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের পক্ষ থেকে রইল অভিনন্দন। করোনা মহামারি সারা বিশ্বকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। শুধু প্রাথমিক নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রাথমিকে যাদের করোনা মহামারি জনিত কারণে শিখন ঘাটতি ছিলো, বর্তমানে সেসব শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ, ৭ম ও অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ে শিখন ঘাটতি দূর করার প্রয়াসে অনলাইনে ও সংসদ টিভিতে পাঠদানের পাশাপাশি অ্যাসাইনমেন্ট বাড়ি বাড়ি যেয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোসহ সংগ্রহ করার কাজটি নিয়মিত করেছেন শিক্ষকেরা। সমাপনী পরীক্ষা অংশগ্রহণের সম্ভবনা থাকায় ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকদের বিশেষ দৃষ্টি ছিলো। করোনা পরবর্তী শিখন ঘাটতি দূর করার নামে শ্রেনির কার্যক্রমের শেষে ১৫ মিনিটের একটি ক্লাস রাখা, বিভিন্ন সময়ে ছুটি কমিয়ে প্রাথমিকের সঙ্গে অন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির বৈষম্য করা হয়েছে। এতদসত্ত্বে শিখন ঘাটতির অপবাদ থেকে মুক্তি পায়নি, প্রাথমিক শিক্ষা। পানির স্বাভাবিক ধর্ম নিচের দিকে গড়ায়। অনুরূপভাবে শিখন ঘাটতির এ অপবাদ প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর বর্তায়। এতো বিশাল মন্ত্রণালয়, মহাপরিচালকের দপ্তরসহ সকলে যেন ধোয়া তুলসী পাতার মতো পাক-পবিত্র। ‘যতো দোষ নন্দ ঘোষ’ সকল দোষ যেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের। সমাজের উচ্চবিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির বিষয়ে কেহ টু শব্দ করেন না। বিষয়টি অনেকটা ‘ভাসুরের নাম উচ্চারণ করা উচিত নয়’-প্রবাদের মতো।

শিখন ঘাটতি দূর করার বিষয়ে কতিপয় চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করছি- 

১. শিক্ষক সংকট: প্রাথমিকের শিক্ষক সংকট দীর্ঘসময় থেকে চলে আসছে। বিগত সময়ে দীর্ঘ প্রায় ৩ বছর পর ৩৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিলো। এ সময়ক্ষেপণ প্রক্রিয়া অনেকটা ‘নদীর একুল গড়ে ওকুল ভাঙে’  প্রবাদের মতো। সুনামগঞ্জসহ দেশের সর্বত্র শিক্ষক সংকটে নিমজ্জিত। প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষকের সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা চলছে, অনেকটা দৌড়ের ওপর। অপরদিকে, ২/১ জন বিশিষ্ট শিক্ষক ছুটি বা অফিসিয়াল কাজকর্ম ব্যস্ত থাকায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে গিয়ে হারিয়ে যায় শিখন ঘাটতি দূর করার স্বপ্ন।

২. হতদরিদ্রের নিচে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে: শিক্ষাবান্ধব সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক অর্জনের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভবন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন নজর কাড়ার মতো। অথচ বেসরকারি-সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা ভর্তিসহ সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয় সুদর্শন ভবন যেন শিক্ষার্থী সংকটে তালগাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চবিদ্যালয়, কলেজগুলো শুরু হয় প্লে/নার্সারী থেকে। শিশুর স্বর্গের পাঠশালার মতো সুসজ্জিত ও শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমারোহের পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে আজ যেন ‘উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ প্রবাদের মতো। এ ছাড়া, যত্রতত্র গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন/এবতেদিয়া মাদরাসা।  এতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী হিসেবে সর্বনিম্ন স্তরের গরিব অভিভাবক বা অভিভাবকহীন শিক্ষার্থীদের টেনে এনে বিদ্যালয়ে কোনোরকমে পড়াতে হয়। দরিদ্রতার কারণে বাবা-মাকে পারিবারিক প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে হয় বিধায় তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে সময় দিতে পারেন না। যার ফলে শিখন ঘাটতিতে ব্যাপকতা থেকে যায়। 

৩. বিদ্যালয়ের সময়সূচি: সারা দেশে বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও এবতেদায়ি মাদরাসা সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দুপুর ২টার পূর্বেই তাদের পাঠদান কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। যার ফলে তারা দুপুরে গোসল করে গরম ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকেলে খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ পেয়ে থাকেন। প্রাথমিকে দীর্ঘ সময়সূচি এদেশের সর্বস্তরে অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের কাছে বিরক্তিকর। অধিকতর শিক্ষাদানের প্রয়াসে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ও সুস্থতা এ সময়সূচির অন্তরায়। যার ফলে শিক্ষার্থী অভিভাবক সরকারি প্রাথমিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। শিক্ষাবান্ধব সরকারের নানা প্রশংসনীয় কার্যক্রম যেমন উপবৃত্তি, পুষ্টিকর বিস্কুট, শিশুবান্ধব বিদ্যালয়ের পরিবেশ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক সবকিছু যেন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। 

বিদ্যালয়ের পিরিয়ডের সময়সূচি: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি পিরিয়ডের সময় ৫০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট। নাম ডাকাসহ কুশলাদি বিনিময়সহ স্বল্প সময়ে শিক্ষার্থীরা বলার ও লেখার ক্ষমতা অর্জন করা কোনো অবস্থাতে সম্ভব হয়ে উঠে না। এ অবস্থায় শিক্ষকেরা সাধারণত শ্রেণিকক্ষে আসা যাওয়াসহ কোনোরকম পাঠ সম্পর্কে আলোচনা করে আগামী দিনে বাড়ির পড়া ও কাজ দিয়ে শ্রেণির কার্যক্রম শেষ করেন। শিক্ষার্থী বাড়ি গিয়ে ক্লান্ত শরীরে বিকেলে খেলাধুলাবিহীন বেশির ভাগ শিশু সন্ধ্যার পর ঘুুমিয়ে পড়েন। ৬টা বিষয়ে বাড়ি পড়া বা কাজ না করায় অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি রেখেই কোনো ক্লাস টপকাতে থাকেন। 

শিখন ঘাটতি দূর করার কতিপয় পরামর্শ

১. শিক্ষক সংকট শূন্য সহিষ্ণুতায় নামিয়ে আনা প্রয়োজন।
২. বেসরকারি-সরকারি কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা বিলুপ্ত করতে হবে। যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন বা এবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। 
৩. শিক্ষকের ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। 
৪. প্রতিটি ক্লাসের সময়সূচি কমপক্ষে ১ ঘণ্টা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী সমস্বরে পাঠ্যাংশ কমপক্ষে ৫ বার পড়ার ব্যবস্থা ও কঠিন শব্দের উচ্চারণ শ্রেণিতে শেখাতে হবে। শিক্ষার্থীর পড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। 
৫. প্রতিদিন ৪টা পিরিয়ডের বেশি পাঠদান হলে শিক্ষার্থীর ওপর বেশি চাপ পড়বে। হাইস্কুল কলেজ, কিন্ডারগার্টেনের মতো দুপুর ২টার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ছুটি দেওয়া প্রয়োজন। যাতে তারা বাড়িতে গিয়ে গোসল সেরে দুপুরে গরম খাবার খেতে পারেন। দুপুরে খাবার খেয়ে, বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে, ফুরফুরে মেজাজে সুস্থ ও সুন্দর দেহে বিকেল বেলা খেলাধুলা, বিনোদন করার সুযোগ পান। রাতে শিক্ষক যে পড়া স্কুলে পড়ায়েছে। শিক্ষার্থী সে পড়া একটু দেখবেন। যেখানে  শিক্ষার্থী বুঝতে অক্ষম হবেন, সে পড়া শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে নেবেন। রাতে টিভিতে শিক্ষার্থী নাটক শিক্ষামূলক বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন। 
৬. প্রত্যেক বিদ্যালয়ে পাঠাগারে শিশু শিক্ষার সহায়ক পর্যাপ্ত বই ও খবরের কাগজ থাকবে। শিক্ষার্থীকে পাঠাগারে বই বা পত্রিকার পড়ার জন্য শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সময় ও সুযোগ প্রতিনিয়ত থাকতে হবে। 

সর্বোপরি তৃণমূলের শিক্ষকদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে শিখন ঘাটতি দূর করার চ্যালেঞ্জ দূর করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিকে সকল ষড়যন্ত্র দূর করা প্রয়োজন।

লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ

 

প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে কেন লটারি - dainik shiksha প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে কেন লটারি এসএসসি ২০২৫-এর ফরম পূরণ ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫-এর ফরম পূরণ ১ ডিসেম্বর কওমি ও আলিয়া মাদরাসার প্রাচীর উঠিয়ে দিতে হবে - dainik shiksha কওমি ও আলিয়া মাদরাসার প্রাচীর উঠিয়ে দিতে হবে শাবাশ অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও দেশপ্রেম - dainik shiksha শাবাশ অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও দেশপ্রেম এইচএসসির ফল তৈরিতে নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এইচএসসির ফল তৈরিতে নতুন নির্দেশনা অধ্যক্ষ মাহবুব মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট - dainik shiksha অধ্যক্ষ মাহবুব মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট এসএসসি ২০২৫ -এর টেস্টের ফল ২৭ নভেম্বরের মধ্যে - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ -এর টেস্টের ফল ২৭ নভেম্বরের মধ্যে এসএসসির নম্বরের ভিত্তিতে হবে বাতিল এইচএসসির ফল - dainik shiksha এসএসসির নম্বরের ভিত্তিতে হবে বাতিল এইচএসসির ফল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043931007385254