প্রাথমিক বৃত্তির ফল নিয়ে তুঘলকি - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক বৃত্তির ফল নিয়ে তুঘলকি

শাকিল কালাম |

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। প্রত্যেক শিশুর মধ্যেই দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের নেতৃত্বের প্রতিভা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হলে প্রতিটি শিশুই কর্ণধারের ভূমিকা পালন করতে পারবেন।তাই তো ইংরেজ কবি Wordsworth লিখেছেন ‘Child is the father of man’ এবং কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর ‘কিশোর’ কবিতায় লিখেছেন,‘ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের অন্তরে/ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা/সব শিশুরই অন্তরে’। দু’ভাষার দু’জন কবি ও একই বাণী উচ্চারণ করেছেন। অর্থাৎ আমাদের শিশুরা বড় হয়ে দেশনায়ক ও জাতির কর্ণধারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। 

শিশুদের প্রথম পাঠশালা হলো তাদের পরিবার। পারিবারিক শিক্ষাই জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত হয়। শিশুদের যোগ্যতম সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে দারুণ প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি শিশু-মনোজগত নিয়ে নির্মিত একটি ভারতীয় সিনেমা ‘হামী’ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ছবির পরিচালক শিশুদের পারিবারিক শিক্ষার প্রভাব, শিশুর মানসিক বিকাশে কী ভাবে প্রভাব ফেলে, তা ফুটিয়ে তুলতে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন!আমাদের দেশে এমন শিশুতোষ চলচ্চিত্র কবে নির্মাণ হবে..সে অপেক্ষায় থাকলাম!

আমাদের ছোটবেলায় প্রাইমারিতে পাবলিক পরীক্ষা নেয়ার কোনো রেওয়াজ ছিলো না।২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইমারি শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালু হয়।পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই বৃত্তি প্রদান করা হতো। করোনা অতিমারির কারণে প্রাথমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।হঠাৎ করে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর আন্ত:মন্ত্রণালয়ের এক সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেয়া হবে। তখন সুশীলসমাজ এবং শিক্ষাবিদসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ, এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান। দেশের ২৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন,‘এই বৃত্তি পরীক্ষার কার্যক্রমে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে’।এর মাধ্যমে কোচিংবাণিজ্য ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধিরও আশঙ্কা রয়েছে।এসব দাবি-দাওয়াকে উপেক্ষা করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। 

বৃত্তি পরীক্ষার তারিখ ও শিক্ষার্থীর হার নিয়েও বারবার সিদ্ধান্ত বদল হয়েছে। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো, বৃত্তি পরীক্ষা হবে ২৯ ডিসেম্বর এবং শিক্ষার্থীর হার হবে ১০ শতাংশ, যা সংশ্লিষ্ট স্কুল নির্ধারণ করবে।পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৩০ ডিসেম্বর এবং হার হবে ২০ শতাংশ। বাংলা, ইংরেজি, অংক এবং বিজ্ঞান প্রতিটি বিষয়ে ২৫ নম্বর করে মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়। উল্লেখ্য, এ বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪  ছাত্র-ছাত্রী অংশ নেন।  

২৮ ফেব্রুয়ারি(২০২৩) দুপুরে গণশিক্ষা প্রতিন্ত্রী মো. জাকির হোসেন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেন। তিনি জানান, ট্যালেন্টপুলে ৩৩ হাজার এবং সাধারণ কোটায় ৪৯ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছেন।বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা প্রতিমাসে যথাক্রমে ৩০০ এবং ২২৫ টাকা করে এবং বছরে এককালীন ২২৫ টাকা করে ৩ বছর ধরে বৃত্তির অর্থ পাবেন। ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, কোনো কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও বৃত্তি পেয়েছেন! বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার পাঁচপাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও সাধারণ কোটায় বৃত্তি পেয়েছেন। বেশ ঘটা করে ফল প্রকাশ করলেও ৬ ঘন্টা পর কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করে ঘোষিত ফলাফল স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী যেসব শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছিলেন, তাদের ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।বৃত্তি পাবার আনন্দে তারা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধদের নিয়ে তা উদযাপন করেছেন। প্রতিবেশিদের মিষ্টিমুখ করিয়েছেন।ফেসবুকে এ অর্জনের খবর প্রচার করেছেন।ফল স্থগিত ঘোষণার পর তাঁদের মধ্যে অনিশ্চয়তাও সৃষ্টি হয়েছে।পূর্ণঘোষিত ফলাফলে কেউ যদি ঝরে পড়েন, তখন তার মনের অবস্থা কেমন হবে, তা কী কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখেছেন! এর প্রভাবে শিশুমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ধরনের ঘোষণাকে ‘দায়িত্বহীন কর্মকান্ড’ বলে অভিভাবক এবং শিক্ষকরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

অপরদিকে..সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ নিয়েও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের কথা রাখতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর স্থগিত ঘোষিত ফলাফল ১ মার্চ বিকেলে প্রকাশ করার কথা থাকলেও, তা প্রকাশিত হয়েছে রাত ১০টা ৪০ মিনিটে। পূর্বে ঘোষিত ফলাফল থেকে পরিবর্তিত ফলাফলে কতোজন শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে, তার প্রকৃত সংখ্যা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানাতে পারেননি। একই সঙ্গে তারা ভুল ফল প্রকাশের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে। বাদ পড়া শিশুরা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত।কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। আবার যারা নতুনভাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন,তারা খুশি হয়ে ভবিষ্যতে আরো ভালো ফলাফল করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।যারা সংশোধিত তালিকায় বাদ পড়েছেন,সেসব শিশুর পারিবারিক, আত্মীয়-স্বজন, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা কেমন হবে, তা কী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখেছেন? 

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কারিগরি ত্রুটি খূঁজে বের করতে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।কিন্তু বাদ পড়া শিশুদের ‘সাড়ে সর্বনাশ’তো হয়েই গেছে। কিছু শিশুর কচিমনে তো কালো দাগ পড়েছে। হৃদয়ে গভীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ছোট ছোট সোনামনিদের দাগ ও ক্ষত সারানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক শাহানা হুদা  লিখেছেন, ‘শিশুদের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষণা নিয়ে যে ভয়াবহ অপরাধ করলো কর্তৃপক্ষ, আমরা এর বিচার চাই’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ লিখেছেন,‘ক্লাস ফাইভে আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম।সরকারের এই সুন্দর উদ্যোগে যারা পানি ঢেলে দিলো,তারা অপরাধী।ভুল নয়,এরা ব্যাপক অপরাধ করেছে’।  

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে শুরু থেকে ফলাফল প্রকাশ ঘোষণা পর্যন্ত চরম গাফিলাতি, খামখেয়ালি এবং একগুয়েমির পরিচয় দিয়েছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন লিখেছেন,‘বোধ হয় পরের বার বৃত্তি পরীক্ষায় ট্রান্সলেশন থাকবে মিষ্টি খাইবার পর ফল বদলাইয়া গেলো’। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন,এই পরীক্ষার বিষয়টি শিশুদের জন্য শারীরিক, মানসিক ও আবেগীয় চাপের উৎস। এখন ফলাফল প্রকাশ করা নিয়েও যদি এমন ঘটনা ঘটে, সেটি হচ্ছে, শিশুদের প্রতি এক ধরনের অত্যাচার’। এটি করার অধিকার আমাদের নেই। শিশুদের জন্য আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। সেটি না করে যদি এ ধরনের বেদনাদায়ক অনুভুতির জন্ম হয়, তাহলে তারা লেখাপড়ার প্রতি বিমুখ হয়ে যেতে পারে।এর ফলে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহের পরিবর্তে ভীতি তৈরি হবে’।

এখানে শিক্ষাবিদের অভিব্যক্তি আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। আমাদের কোমলমতি শিশুদের মনে যদি এর বিরূপ প্রভাব পড়ে, তাহলে তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ কী হবে? দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের জন্য তারা কী ভুমিকা রাখতে পারবেন? সম্প্রতি আমাদের শিশুদের নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ যে তামাশা করেছে, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে দেশবাসী ভীষণ উদ্বিগ্ন ও হতাশ।সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সব ভুলচুক পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে যাতে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে ফলাফল প্রকাশ করা যায়, সকল কর্মকর্তারা সেদিকে অধিক মনোযোগী হবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

লেখক : শাকিল কালাম, কবি ও মানবাধিকারকর্মী

 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046670436859131