‘প্রাথমিক শিক্ষা, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দীক্ষা’ এই স্লোগান নিয়ে এবারের প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৩ (১২ মার্চ) শুরু হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ধারণাটি কিন্তু নতুন স্বপ্ন নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সঙ্গেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তার শুরু হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। কারণ..প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক ধাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেন।শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশসাধন, আচরণিক পরিবর্তন, সামাজিক মূল্যবোধের প্রাথমিক স্তর শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। শিশুদের এই ইতিবাচক পরিবর্তনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন..তারা হলেন এই স্তরে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষিকা। অন্য যে কোনো স্তরের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এই স্তরের প্রকৃতির কারণেই চ্যালেঞ্জ থাকে। এখানে যাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হয়..তারা শিশু। তারা তো সামাজিকীকরণের শুরুতে থাকেন। তারা শিক্ষা স্তরের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রমের পর্যায়ে থাকেন। এই শিক্ষাই পরবর্তী সময়ে তার ভেতর প্রবাহিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নে উপকরণ, ডিজিটালাইজেশন এবং প্রশিক্ষণসহ নানামুখি কার্যক্রমের মাধ্যমে আধুনিকায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে আগের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটেছে। তারপরও প্রাথমিক শিক্ষা আশানুরুপ অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
মানুষের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ধারণা বদলেছে এবং আগ্রহও বেড়েছে। ইতোমধ্যেই নতুন শিক্ষক যোগদান করেছেন এবং আবারো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। ফলে শিক্ষক সঙ্কটের যে বিষয়টি ছিলো, সেটি অনেকটাই কমে যাচ্ছে।তাছাড়া এখন প্রাথমিক শিক্ষায় নারী-পুরুষ উভয়ই উচ্চ শিক্ষিত এবং নামী-দামী সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষে এখানে আসছেন।যদিও প্রশ্ন থাকে..তাদের কতোজনকে ধরে রাখা যাচ্ছে? আর যদি চূড়ান্ত মেধাবীদের ধরে না রাখা যায়,তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা অগ্রগতির যে বিষয় তা অর্জনে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।এখানে প্রশ্ন হলো,খুব মেধাবীদের আগ্রহ এখনও প্রাথমিক শিক্ষায় কম কেনো? প্রশ্নোত্তরে জানতে হবে প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি। আজও তারা নিচের দিকের গ্রেডেই আটকে আছেন!
এমন কী প্রধান শিক্ষক পদে নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা অনেকেই থাকছেন না এমন সংবাদই গণমাধ্যমে পাওয়া গেছে। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। একই যোগ্যতায় তার সঙ্গে কেউ ওপরের গ্রেডে চাকরি করছেন, তা হলে তিনি পিছিয়ে থাকবেন কেনো? অর্থাৎ মাপকাঠি হলো..গ্রেড বা বেতন কাঠামো। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিক্ষকদের জীবন।এই মানুষগুলোর হাতেই শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন নির্ভর করে।
শিক্ষা উপকরণ, উপাদান বা পদ্ধতি সবকিছুর সফলতা নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। আজ শিক্ষা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।একটি নতুন কারিকুলাম এ বছরই প্রথম বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রাথমিকের দ্বিতীয় শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর আরও শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত হবে। এই যে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন এটা করবেন শিক্ষকরা। সুতরাং তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয় বা দাবির বিষয় বিবেচনা করতে হবে। তাদের জীবনযাত্রার দিকে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে স্বল্প বেতনে একটি সংসার ব্যয় নির্বাহ করা যে কী কষ্টসাধ্য..তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ জানেন না। যদিও সহকারি শিক্ষকদের বেতন গ্রেডের উন্নয়ন হয়েছে। আগে প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণবিহীনরা যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ গ্রেডে বেতন পেতেন। এখন তা ১৩তম গ্রেডে উন্নীত হয়েছে।
এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। কিন্তু দেখতে হবে..এখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতার পুরোপুরি মূল্যায়ন হবে কীনা বা মেধাবীদের এখানে টানতে হলে কী করা প্রয়োজন অথবা কেনো তারা কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। অর্থ সবকিছুর মাপকাঠি না হলেও অনেকটা তো বটেই! সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর।
কথায় কথায় আমরা বলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়। এমন কী প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদাও বেশি। কিন্তু সেসব দেশে শিক্ষক নিয়োগে কঠিন-কঠোর পরীক্ষা দিতে হয়। নৈতিক-মানসিক ও অর্থনৈতিক সততা যাচাই করা হয়। শিক্ষক হওয়ার লাইসেন্স রিনিউ করতে বছর বছর পরীক্ষা দিতে হয়।
বিনীতভাবে বলতে পারি, এই পেশা থেকেই তাঁর সংসার নির্বাহ হয়, শিক্ষার বিশ্লেষণ হয় এবং তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়! আর যার যা পাওনা-তাকে যদি তা দেওয়া না যায় তাহলে তার কাছ থেকে কী ‘কাঙ্ক্ষিত ফল’ আশা করা যায়? একই যোগ্যতায় যদি অন্য চাকরিতে দশম গ্রেডে বেতন পান..তাহলে প্রাথমিক শিক্ষকরা পেতে পারেন না কেনো? তাদের দুর্বলতা কোথায়? প্রশ্ন হলো..যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নের। বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় এই ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন কী মাধ্যমিকে একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং প্রাথমিকের একজন সিনিয়র শিক্ষকের ভেতর এবং একই যোগ্যতায় অন্য কোনো যোগ্যতার মধ্যে এই পার্থক্য বেশ চোখে পড়ে। কোনো নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা একজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী কেনো স্বেচ্ছায় প্রাথমিকে চাকরি করবেন..যদি তাকে সেখানে যোগ্য সম্মান দেওয়া না হয়।
মুখে যতোই বলি প্রাথমিকেই মেধাবীদের আনতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব হবে..তা নিয়ে আলোচনা হলেও ফলপ্রসূ হয়নি আজো। এই ক্ষেত্রে যারা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী তাদের সঠিক মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। এখন প্রাথমিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত মিনিমাম যোগ্যতা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ডিগ্রি পাস করা হয়েছে-তবে মাস্টার্স শেষ করে আসছেন অনেকেই। ফলে তাদেরকে উচ্চশিক্ষার সনদধারী এবং মেধাবী বলা যায়।
এক সময় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা এসএসসি এবং এইচএসসি পাস থাকলেও এখন সে সুযোগ নেই। যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রতিটি চাকরিজীবীই আশা করেন। মানসম্মত শিক্ষাই আমাদের লক্ষ্য। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতার মাপকাঠি সকল ক্ষেত্রে এক করতে হবে। প্রাথমিকে শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। একজন সহকারি শিক্ষক হিসেবে যখন তিনি যোগদান করেন, তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকরির আশা করতে পারেন। কারণ, অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে.. এখানে ততো গতিতে নেই।
সহকারি শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। যদিও সম্প্রতি এ নিয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা দ্রুত বাস্তবায়িত হতে হবে এবং সেই প্রক্রিয়াও হবে দ্রুত। একজন শিক্ষক..সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর যেনো নির্দিষ্ট সময় পর প্রধান শিক্ষক এবং পরবর্তীতে তিনি যেনো উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত যেতে পারেন..সে পথটুকু সুগম করতে হবে। এতে যা হবে তা হলো, চাকরির প্রতি দায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং একটি লক্ষে তিনি অগ্রসর হবেন। প্রয়োজনে মেধাভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু হতে পারে। বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে যারা মেধাবী তারা পদোন্নতির সুযোগ পাবেন। এর ফলে মেধাবীরা তাদের মেধার দ্বারা দ্রুত অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে পারবেন এবং চাকরি নিয়ে কোনো অসন্তোষও থাকবে না।
প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সব শিক্ষাস্তরের ভিত্তি। সরকার এই স্তরকে শক্তিশালী করতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি গুণগত মান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে..যারা এই শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত। নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। সেই দায় শিক্ষকদের ওপরেও বর্তায়। প্রাথমিক শিক্ষকদের অনেকেই নিজের সন্তানকে নামী-দামী কিন্ডারগার্টেনে পড়ান। এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন ভাবুন, আপনার সন্তানকে আপনি যদি কিন্ডারগার্টেনে পড়ান..প্রাথমিকের পরিবর্তে তাহলে অন্য অভিভাবকের কাছ থেকে আপনি আপনার স্কুলে সন্তান ভর্তি আশা করতে পারেন? যদি সেই অভিভাবক প্রশ্ন করেন-আপনার সন্তান কোথায় পড়েন, আপনি কী জবাব দেবেন? সুতরাং প্রথমে নিজের কাজের ওপর নিজের বিশ্বাস আনতে হবে। যদি না পারেন, তাহলে অন্যরা আপনাকে কেনো ভরসা করবে? নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে আস্থা না থাকে তাহলে অন্য অভিভাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কী ? এটা একটা কারণ মাত্র, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই তা করে দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বহুমুখি পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে গত কয়েক দশকে শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকদের জীবন মান, শিক্ষার্থী উন্নয়ন বহুগুণে বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু সবকিছুর সঙ্গেই শিক্ষকদের চাকরি জড়িত থাকে। সেখানের উন্নয়ন শিক্ষকের মানসিক প্রশান্তির কারণ হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর।এ কথা সবাই স্বীকার করেন।সে ক্ষেত্রে এই ক্ষেত্রে যে অসঙ্গতিগুলো রয়েছে-তা দূর করতে হবে। শিক্ষকদের চাকরির সন্তুষ্টি অর্জন ও তাদের কষ্টের জায়গাগুলোতে পর্যায়ক্রমে পূর্ণ করতে হবে। মেধাবী শিক্ষক টানতে শিক্ষকদের গ্রেড অন্য চাকরির সঙ্গে সামঞ্জস্য করা, পদোন্নতি দেয়া, টিফিন-ভাতা এবং বিদ্যালয়ের সময়সূচির পরিবর্তনে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।
লেখক : অলোক আচার্য, শিক্ষক, কলামিস্ট