শিক্ষায় বিগত সরকারগুলো নানা সাফল্যের পরেও এটা স্বীকার করতে হবে, প্রাথমিক শিক্ষায় আজও অভিজ্ঞ, মেধাবী জনবলের নিদারুণ অভাব রয়েছে। শিশুশিক্ষায় নীতিনির্ধারণসহ সব পর্যায়ে প্রয়োজন প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করা অভিজ্ঞ, দক্ষ জনবল। এজন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস।
বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় অনার্স মাস্টার্সরা শিক্ষকতা করছেন। এ ছাড়া রয়েছে উচ্চশিক্ষিত দক্ষ, সহকারী শিক্ষা অফিসার। সহকারী শিক্ষকদের এন্ট্রি পদ ধরে শতভাগ পদোন্নতি সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত চালু করে প্রাথমিক শিক্ষায় ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করার বিষয়টি আজ অনস্বীকার্য।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে একটি সুদৃঢ় কাঠামোতে আনার লক্ষ্যে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার পদের কম্পোজিশন পুনর্বিন্যাস করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়সংক্রান্ত ৩১৮টি পদ অর্ন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন ও অবৈতনিক। এ লক্ষ্যে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষাকে আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের প্রজ্ঞাপন মূলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ’ নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগের সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক শিক্ষাসংক্রান্ত সব দায়-দায়িত্ব এ বিভাগকে অর্পণ করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব ও কাজের পরিধি অনুধাবন করে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেক এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের সচিব ড. সাদত হোসাইন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় গঠন এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাঠপর্যায়ের ক্যাডার পদগুলো পৃথকীকরণের জন্য তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করেন।
পরবর্তীকালে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নামে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় গঠন করা হলেও মন্ত্রণালয়ের জন্য পেশাভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদের সমন্বয়ে একটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো তথা প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার আজও গঠন করা হয়নি এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ক্যাডারভুক্ত পদগুলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (জেনারেল এডুকেশন) কমিশনের-এর আওতায় থেকে যায়।
এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের আওতা থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পদগুলোকে আলাদা করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার নামে একটি পৃথক ক্যাডার গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে। প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় কর্মরত বিদ্যমান জনবল নিয়ে নবগঠিত এ মন্ত্রণালয় যাত্রা শুরু করে। প্রেষণাধীন কর্মকর্তা ব্যতীত মূলত ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে সংশোধিত ক্যাডার রুলের আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের জনবল ও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে প্রাথমিক শিক্ষার নিজস্ব জনবল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়েই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষা কমিশন-২০০৩-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিলো, তখন প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কিছু পদকে ক্যাডারের পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এগুলো সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের পদ হিসাবে চিহ্নিত। প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নতুন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পদগুলো শিক্ষা ক্যাডারে থাকার আর কোনো যৌক্তিকতা থাকে না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ এখন স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় বিধায় এর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার গঠিত হতে পারে। এ লক্ষ্যে প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও তা এখনো চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি। বর্তমানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার ও পিটিআইয়ের ইন্সট্রাক্টর পদে যারা যোগদান করেছে, তাদের ধরে রাখতে হলে এবং এ সার্ভিসের উন্নয়ন করতে চাইলে দুটি পদকে ক্যাডার সার্ভিসের এন্ট্রিপদ হিসেবে চিহ্নিত করে ক্যাডার গঠন করতে হবে।
পরবর্তীকালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প, এস্টিম প্রকল্প, আইডিএ প্রকল্প এবং পিইডিপি ২ ও ৩-এর আওতায় সৃষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, শিক্ষা অফিসার, গবেষণা অফিসার ও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)-এর সমতুল্য ২২৮টি পদ রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ করা হয়।
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের পিইডিপি-২-এর কার্যক্রম শুরু হয়। পিইডিপি-২-এর প্রোগ্রাম ডকুমেন্টে অর্গানাইজেশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের আওতায় বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার থেকে প্রাথমিক শিক্ষার অংশ পৃথক করে বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের সারসংক্ষেপ প্রেরণ করা হয়েছিলো।
প্রেরিত সারসংক্ষেপে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার পদসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে সব প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়ে (সিস্টেম অ্যানালিস্ট, প্রোগ্রামার, প্রকিউরমেন্ট ও সাপ্লাই অফিসার, উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার, পিটিআই ইন্সট্রাক্টর, ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর এবং স্টোর কর্মকর্তা) পদ সমন্বয়ে বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের প্রস্তাব করা হয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাতে নীতিগত সম্মতি প্রদান করেছিলেন। অথচ নীতিগত সম্মতি দান করলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার থেকে প্রাথমিক শিক্ষার অংশ পৃথক করে বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের জন্য পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত সারসংক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি সারসংক্ষেপ প্রেরণ করা হয়। এর পরও ক্যাডার কম্পোজিশন, যৌক্তিকতা, নীতিগত সিদ্ধান্ত ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সভা হলেও আলোর মুখ দেখেনি বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার।
বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের যৌক্তিকতা: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের প্রাথমিক শিক্ষার ৩১৮টি পদসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন সব প্রথম শ্রেণির পদ নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বিসিএস।
(প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের যৌক্তিকতা: ক. ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এক লাখ ৫৬ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেন এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে আরো ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ এক লাখ পাঁচ হাজার ৬১৬ জন শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেন। বর্তমানে দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজার সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এ কার্যক্রমের সঙ্গে চার লাখ ৭৭ হাজার ১২৫ জনের অধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন যা বাংলাদেশের সব সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ। তিন ভাগের দুই ভাগের জন্য ২৮টি বিসিএস ক্যাডার থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোনো বিসিএস ক্যাডার নেই। প্রাথমিক শিক্ষার এ বিশাল কর্মযজ্ঞের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থেই বিসিএস (প্রাথমিক ক্যাডার) গঠন করা প্রয়োজন।
খ. প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত টাস্কফোর্স প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি পৃথক ক্যাডার সৃজনের জন্য সুপারিশ করে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত জাতীয় পরিকল্পনাতেও বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের সুপারিশ রয়েছে। জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-২০০৩-এ বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠনের সুপারিশ রয়েছে। তা ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-২ বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তিতে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো।
গ. যুগের বিবর্তনে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে এবং নতুন প্রযুক্তি বিকাশের ফলে প্রাথমিক শিক্ষা সমগ্র বিশ্বে সাম্প্রতিককালে একটি টেকনিক্যাল বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার কৌশলগত দিক বিবেচনা করলে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সদাসম্পৃক্ত অভিজ্ঞ ও দক্ষ একটি জনবল সৃষ্টি করা আবশ্যক। এ কারণে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে পৃথক বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠন প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করবে।
ঘ. বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠন এ সেক্টরে কর্মরত জনবলকে অধিকতর গতিশীলতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালনা ও নিবিড়ভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য নিবেদিত করবে। উচ্চশিক্ষিত, সুপ্রশিক্ষিত, প্রণোদিত, অঙ্গীকারাবদ্ধ ও নিজস্ব ক্যাডার কর্মকর্তা প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য একান্ত প্রয়োজন।
ঙ. প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল কর্মপরিধি ও জনবলের বিস্তৃতি এবং ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অনেক বেশি। পৃথকভাবে বিসিএস (প্রাথমিক শিক্ষা) ক্যাডার গঠিত হলে প্রাথমিক শিক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষিত, প্রতিভাবান কর্মকর্তারা এ সেক্টরে যোগদানের জন্য উৎসাহিত হবেন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ওই ক্যাডার রূপকল্প ২০৪১-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং দারিদ্র্যবিমোচন কৌশল বাস্তবায়নের স্বার্থে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
চ. বাংলাদেশে ২৮টি বিসিএস ক্যাডারের মধ্যে বেশ কয়েকটি সিভিল সার্ভিসের সদস্য সংখ্যা ১০০-২০০। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রথম শ্রেণির ২৫৪১টি পদ থাকা সত্ত্বেও পৃথক কোনো ক্যাডার নেই। অন্যান্য ক্যাডারের মতো প্রাথমিক শিক্ষায় সরাসরি বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ হলে অফিসারদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা, দক্ষতা, সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার না থাকার নেতিবাচক দিকগুলো: ক. প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত অধিকাংশ কর্মকর্তা বদলি ও প্রেষণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে কমর্রত থাকায় তারা তাদের নিজস্ব ক্যাডারের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অর্জিত অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ করার পর্যাপ্ত সুযোগ পান না। অধিকন্তু প্রেষণে নিয়োজিত এসব কর্মকর্তাকে প্রাথমিক শিক্ষাসম্পর্কিত দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলার পর প্রাথমিক শিক্ষাবহির্ভূত অন্যত্র প্রত্যাবর্তন ও পদায়নের ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার কোনো প্রতিফলন পাওয়া যায় না।
খ. বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা নিয়মিত ক্যাডারের সদস্য না হওয়ায় তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট ক্যারিয়ার ওয়ে নেই। তাদের অধিকাংশই যে পদে চাকরি শুরু করেন সে পদ থেকেই অবসর গ্রহণ করে থাকেন।
গ. দেশে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় চার লাখ ৭৭ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োজিত আছেন। এর মধ্যে ২৫৪১ জন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত। দেখা যায় বাকি প্রায় ১০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ২৮টি ক্যাডার বিদ্যমান। অথচ প্রায় পাঁচ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র কোনো ক্যাডার নেই।
ফলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণপূর্বক মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে না।
ঘ. একটি পৃথক ক্যাডার এবং ক্যারিয়ার পাথ না থাকার কারণে উচ্চ শিক্ষিত প্রতিভাবান, চৌকস ব্যক্তিরা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে আকৃষ্ট হন না। একই কারণে নিন্মপদে যোগদানকারী উচ্চ মেধাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ধরে রাখাও সম্ভব হয় না।
চার লাখ ৭৭ হাজার ১২৫ জনের অধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষায়, যা দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তিন ভাগের দুই ভাগের জন্য ২৮টি বিসিএস ক্যাডার থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোনো বিসিএস ক্যাডার নেই। প্রাথমিক শিক্ষার এ ব্যাপক কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থেই বিসিএস (প্রাথমিক ক্যাডার) গঠন করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল কর্মপরিধি ও জনবলের বিস্তৃতি এবং ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অনেক বেশি। পৃথকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার গঠিত হলে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষিত, প্রতিভাবান কর্মকর্তা এ সেক্টরে যোগদানের জন্য উৎসাহিত হবেন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ জন্য প্রয়োজন সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি ধরে নীতি নির্ধারণী পর্যায় পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতি। আশা করি অন্তবর্তিকালীন সরকার বিষয়টি সু-নজর দিবেন।
লেখক: শিক্ষাবিদ