শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষিত জাতি গড়ে উন্নত দেশ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন “সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারেনা।” তিনি আরো বলেছিলেন “দারিদ্র যেন উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাঁধা হয়ে না দাড়াঁয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।” জাতির পিতা বাঙালি জাতিকে শিক্ষিত উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিককরণ, প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও স্থাপনসহ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ তথা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে শিক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, বিশ্বমানের আলোকিত জাতি গঠনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নে জাতির পিতা দেশের প্রান্তিক জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভাগ্য উন্নয়নে ছোট বা ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জামানত ও সুদ বিহীন ঋণ প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং এরই প্রেক্ষিতে Rural Social Service (RSS) প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশে প্রথম সুদ ও জামানত বিহীন ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পরবর্তিতে স্বেচ্ছাসেবী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতায় এসেই এ খাতের উন্নয়ন ও নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন। নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় স্টাডি ও গবেষণার মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সহায়ক ক্ষুদ্রঋণ খাত বিনির্মাণে আইনের মাধ্যমে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিধি ও প্রবিধি প্রণয়ন এবং উপযুক্ত কার্যপদ্ধতি নির্ধারণের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্রঋণ খাতের সার্বিক উন্নয়নে এমআরএ নিরলসভাবে কাজ করছে। এমআরএ'র সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই), বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা এবং গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত এই বিশাল আর্থিক সেবা খাত ঋণ প্রদান ও সঞ্চয় কার্যক্রমের মাধ্যমে ছয় কোটির অধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন সেবা দিচ্ছে। জুন ২০২২ এর তথ্যানুযায়ী, এমআরএ'র সনদপ্রাপ্ত ৭৩৯টি প্রতিষ্ঠান প্রায় চার কোটি মানুষকে ক্ষুদ্রঋণ সেবা দিচ্ছে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির সনদপ্রাপ্ত এ সব প্রতিষ্ঠান সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, দুর্যোগ মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ৪৩৮.৭১ কোটি টাকা বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে ব্যয় করেছে। এসব কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার উন্নয়ন করে আসছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, কারিগরি, মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করা; প্রয়োজনে বিদ্যালয় পরিচালনা করা, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান ইত্যাদি।
ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের এই শিক্ষা কার্যক্রমকে জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে আরো কার্যকর করার জন্য এবং দেশের সুবিধাবঞ্চিত ও অস্বচ্ছল প্রান্তিক মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করতে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে “বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি" প্রদান কার্যক্রম নেয়। এই উচ্চশিক্ষা বৃত্তির মাধ্যমে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সহায়তা করবে। একইসাথে, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আরো বেশি উৎসাহিত করবে। আর এভাবেই গড়ে উঠবে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এসডিজি'র ১৭টি লক্ষ্যের ৪ নম্বর লক্ষ্যে “মানসম্মত শিক্ষা" নিশ্চিতকল্পে বলা হয়েছে, "অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতা ভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা"। এছাড়া ৪ নম্বর লক্ষ্যের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ৪.৩ এ বলা হয়েছে, “২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, ব্যয়সাধ্য ও মানসম্পন্ন প্রযুক্তি, কারিগরি এবং উচ্চশিক্ষায় নারী ও পুরুষের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করবে"। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় এসব অঞ্চলের অস্বচ্ছল পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে বাছাই করে এবং এমআরএ’র অনুমোদনক্রমে “বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি” প্রদানের মাধ্যমে তাদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করে তুলতে সক্ষম হবে। ফলে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ ঈর্ষণীয়, বিস্ময়কর। নারীর ক্ষমতায়নেও বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাতের ন্যায় উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার নানারকম পদক্ষেপ নিয়েছে। উচ্চশিক্ষায় নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিতকল্পে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি প্রণীত “বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি নীতিমালা ২০২০”- এ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বৃত্তির ন্যূনতম ৪০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থীদেরকে দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। ফলে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রান্তিক পর্যায়ের সুবিধাবঞ্চিত নারী শিক্ষার্থী বাছাই করে “বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি” প্রদানের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরিকল্পনায় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত এবং গবেষণারত অস্বচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয়েছে “বঙ্গবন্ধু উচ্চ শিক্ষা বৃত্তি”। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ এবং পরবর্তীতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য নির্বাচিত বা অধ্যয়নরত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যায়নরত মেধাবী শিক্ষার্থীগণকে এই বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। এমনকি ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কিত ডক্টোরাল ও পোস্ট ডক্টোরাল পর্যায়ে গবেষণারত বা অধ্যায়নরতরাও এই বৃত্তি পেতে পারেন।
‘বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি নীতিমালা, ২০২০' এর আওতায় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রান্তিক পর্যায় থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের মাসিক ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা করে পূর্ণ শিক্ষাজীবনে (সর্বোচ্চ ৮ বছর) এই বৃত্তি দিচ্ছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ৮৯টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ৭১৯ জন শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা ‘বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি' দিয়েছে। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ৪৩ শতাংশ নারী। বৃত্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে নৃগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী রয়েছেন। প্রতি বছর এ বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। মূলত মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত আয় হতে এই বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
কোভিড ১৯ মহামারীর পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বিবেচনা করে অনলাইন ও ব্যাংক চেকের মাধ্যমে এ বৃত্তি বিতরণ করা হয়েছে। বৃত্তির প্রাসঙ্গক তথ্য নিয়ে ‘স্বপ্নযাত্রা' নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশ করা হয়েছে। মূলতঃ ‘বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি' প্রান্তিক পর্যায় থেকে সংগ্রাম করে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের চলার পথ সুগম করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এবং এ পথ ধরেই আমরা পাবো উন্নত জাতি, উন্নত সমৃদ্ধ দেশ তথা জাতির পিতার স্বপ্নের 'সোনার বাংলা'।
লেখক : মো. ফসিউল্লাহ্, এক্সিকিউটিভ ভাইস, চেয়ারম্যান, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি