চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উপলক্ষে গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে এর চেয়ে আর খারাপ হবে না। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনীতির যে সহনশীলতা, সেটি অত্যন্ত গভীর। যেকোনো একটি ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পড়ে যাবে না। কভিডের সময় আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।’
নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তিনটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপ্তি, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর আগ্রাসী কার্যক্রম এবং চীনের কভিড পরিস্থিতি। গভর্নর এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যত দ্রুত এ তিন চ্যালেঞ্জের সমাধান হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতিও তত দ্রুত বাউন্স করবে। বিদ্যমান এ তিন চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতি যদি আরো খারাপ হয়, তাহলেও দেশের অর্থনীতির বর্তমান যে অবস্থা আছে, তার চেয়ে খারাপ হবে না। স্বল্পমেয়াদে আমাদের দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে। আমরা আশা করি, ভালো দিন শিগগিরই আসবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে গতকাল বিকালে ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন ২০২৩) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান নতুন মুদ্রানীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। পরে গভর্নর ১ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। দেশের ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের সংকট, অর্থ পাচার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাসহ দেশের অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
গত বছরের ১২ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বাদশ গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেন। গভর্নর হিসেবে এটি ছিল তার প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা। অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত রেপোর সুদহার হবে ৬ শতাংশ। আগে রেপোর সুদহার ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ হিসেবে রেপোর সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে।
একইভাবে সুদহার ২৫ বেসিক পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে রিভার্স রেপোর। আগামী জুন পর্যন্ত রিভার্স রেপোর সুদহার হবে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। রেপো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার হিসেবে বেশি পরিচিত। মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়া হয়।রেপোর সুদহার বাড়ানো হলেও ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশেই ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে এ সুদহার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতদিন মৌখিকভাবে ভোক্তাঋণের সুদহার অতিরিক্ত ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমতি ছিল। ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার পরিবর্তিত না হলেও ব্যাংক আমানতের সুদহারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রাহকদের সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে।
দেশের ব্যাংক খাতে এ মুহূর্তে তারল্য সংকট চলছে। বেশকিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজেদের নির্ধারিত সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। এ অবস্থায় রেপোর সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তারল্য পরিস্থিতিকে আরো বেশি চাপে ফেলা হলো কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘বাজারে অর্থপ্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। এসব তহবিলের সুদহার দেড় থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ। আমরা চাই ব্যাংকগুলো কৃষি, সিএসএমই, রফতানিমুখী শিল্পসহ উৎপাদনমুখী বিভিন্ন শিল্পের জন্য গঠিত তহবিল থেকে অর্থ নিক। এর মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। সুদহার বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলো রেপো থেকে ধার নেয়ায় নিরুৎসাহিত হবে। ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানো হলে দেশের রফতানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে এখনই ঋণের সর্বোচ্চ সুদের ক্যাপ তুলে নেয়া হবে না। তবে ধীরে ধীরে ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে।’
গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংকগুলোয় সরকারি বিভিন্ন সংস্থার যেসব আমানত ছিল, সেগুলো কমে এসেছে। বিপিসি, পেট্রোবাংলা, বিপিডিবিসহ সরকারি বড় সংস্থাগুলোর আমদানি দায় পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভের প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। এ কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য চাপ তৈরি হয়েছে। চাপ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।’
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নেয়ার জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার হয়েছে। এ কারণে কিছু মানুষ ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নিয়েছিল। ওই সময় ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছিলাম। বলেছিলাম, কোনো মানুষ ব্যাংকে এসে যেন টাকা ছাড়া ফেরত না যায়। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়েছে। আপনারা জানেন, টাকা তুলে ঘরে নিয়ে যাওয়ার ফল কী হয়েছে।’
দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থবছর শেষে এ ঘাটতি ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে থামবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে। ৮ জানুয়ারি রিজার্ভের গ্রস পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। তবে চলতি অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও সুশাসন পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে দেশে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ঘিরেও নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ব্যাংকটি এতদিন অন্য ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দিয়ে এলেও বর্তমানে নিজেই ধার করছে। এ পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১ কোটি ৯০ লাখ গ্রাহকের ব্যাংক। ব্যাংকটির হাতে ১ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া মূলধন সে তুলনায় খুবই কম। গ্রাহক ও আমানতকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে আমরা তারল্য সহায়তা নিয়ে ব্যাংকটির পাশে দাঁড়িয়েছি। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রতিদিন যত টাকা তোলা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি জমা হচ্ছে। আশা করছি, চার-পাঁচ মাস পর ব্যাংকটি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে।’