ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে এখন বাংলাদেশ। এমনকি তাদের ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও প্রভাব বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশগুলো এখন বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে লড়ছে। গত মঙ্গলবার ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘বিগ পাওয়ারস ব্যাটেল ফর ইনফ্লুয়েন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক মন্তব্য প্রতিবেদন এ কথা বলা হয়েছে। এ প্রতিবেদন লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাফী মো. মোস্তফা।
দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংয়ের সংক্ষিপ্ত ঢাকা সফরে দেশটির কূটনৈতিক ঐতিহ্য কার্যত ভেঙে গেছে। কারণ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রতিবছর আফ্রিকার কোনো দেশকে তাদের প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্যে পরিণত করার বিষয়ে দীর্ঘদিন চালু থাকা প্রথা মেনে এলেও এ বছর নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে ঢাকায় আসেন। যদিও কিন সে সময় আফ্রিকায় যাচ্ছিলেন ও ঢাকায় তার কোনো সরকারি সফর ছিল না। তারপরও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশের রাজধানীতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি ও মাঝরাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বিমানবন্দরে তার সাক্ষাৎ ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয়টি ঢাকা ও বিদেশি কূটনীতিকদের নজর এড়ায়নি। কিনের সেই সফরের পরপরই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপপ্রধান চেন ঝোয়ের নেতৃত্বে সিসিপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। সফরে প্রতিনিধিদলটি ২০তম সিসিপি জাতীয় কংগ্রেসের স্পিরিট তথা মূলকথা ব্যাখ্যা করে নানা বক্তৃতা দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে, তা হলো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। পররাষ্ট্রনীতির এই কৌশল বাংলাদেশের জন্য ভালো কাজ করেছে। তবে দিন যত যাচ্ছে বৃহৎ পরাশক্তিগুলো তাদের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে ঢাকাকে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান বাংলাদেশকে ‘কোয়াডে’ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে বিগান সেসময় ‘অংশীদারত্ব বৃদ্ধি, মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিককে এগিয়ে নিতে’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেন। সেসময় তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এই অঞ্চলে আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) কাজের কেন্দ্রবিন্দু হবে।’
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে টানতে তখন যুক্তরাষ্ট্রের সেই প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল চীন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সতর্ক করে দেন, চার দেশের জোট অর্থাৎ কোয়াডে যোগ দিলে ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। যদিও চীন প্রায়ই বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়েছে, তারপরও পেইচিং উল্টো কাজটিও করে আসছে। চীন তার গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) যোগ দিতে বাংলাদেশকে প্ররোচিত করছে।
এদিকে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বাগ্যুদ্ধও চলছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোতে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছিলেন। তিনি সেসময় বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করছেন’।
এর আগে ঢাকায় রাশিয়ান দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে নিজেদের ‘উন্নত গণতন্ত্র’ হিসেবে দাবি করা দেশগুলোর ‘আধিপত্যবাদী উচ্চাকাক্সক্ষার’ সমালোচনা করা হয়। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে, যারা নিজেদের ‘বিশ্বের শাসক’ বলে মনে করে সেই রাষ্ট্রগুলো অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কাজ করে চলেছে।’
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিসংক্রান্ত বিষয়ে পিটার হাসের ক্রমবর্ধমান নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সমালোচনামূলক এই বক্তব্য সামনে এসেছিল।
গত বছর জুন মাসে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন পরিদর্শনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে দেখা করেন। সেসময় রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দেশে স্বচ্ছ নির্বাচনের আহ্বান জানান। বাংলাদেশে চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, ২০১৩ ও ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচন ব্যাপক অনিয়মের জন্য বিশ্বব্যাপী সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল এবং এখনো উদ্বেগ রয়েছে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন করবে না। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এক দশক ধরে নিখোঁজ বিরোধী দলের নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারকে দেখতে যান। গত এক দশকে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছে। আবার অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠা বিএনপি অর্থনীতিতে সরকারের ভুল ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এগুলো গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি বিশাল সমাবেশে পরিণত হয়েছিল। তবে সেখানেও বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর ঢাকায় মহাসমাবেশের কয়েক দিন পর সুমনের বাসায় যান পিটার হাস।
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সমালোচনার জবাবে সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। ঢাকায় দেশটির দূতাবাস এক টুইট বার্তায় বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।
রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি নিয়ে মোমেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ চায় না রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত জায়গায় অবস্থান বাংলাদেশেকে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছে। ভূরাজনীতির অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ রবার্ট কাপলান ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘ভারত মহাসাগর হবে বিশ্বব্যাপী সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু’। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে শিপিং বা পরিবহনের রুট হিসেবে এর গুরুত্ব রয়েছে। ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরে পরাশক্তিগুলোর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে চীনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সারা বিশ্বেই সুবিদিত। ভারত মহাসাগর এবং এর বিভিন্ন উপসাগর দিয়ে আফ্রিকার সঙ্গে চীনের বেশিরভাগ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এ ছাড়া নিজেদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এই অঞ্চলে চীনা উপস্থিতি বাড়ানোরও চেষ্টা করেছে পেইচিং। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, অতীতে পাকিস্তান এবং ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বলে যদি এখন ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বলতে হবে ওয়াশিংটন এখন ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশ, নেপাল ও মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ সোচ্চার হয়েছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন।
এতে বলা হয়েছে, অবশ্য বড় পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ আরও দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংকট, সরকারের বৈধতা নিয়ে সংকট, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে দেশটির স্বাধীন ও যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল; বাংলাদেশি পণ্যের একক বৃহত্তম বাজারও সেখানে। এ ছাড়া এশিয়ায় যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পেয়ে থাকে বাংলাদেশ তাদের একটি। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক। বাংলাদেশে পেইচিংয়ের বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার; যা কোনো একক দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি।
পরাশক্তিগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সীমিত করেছে বলে দাবি ডিপ্লোম্যাটের। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ‘গণতন্ত্রের লাঠি’ ব্যবহার করে বাংলাদেশকে নিজেদের দিকে টানছে, সেখানে চীন ও রাশিয়া আওয়ামী লীগ সরকারকে আর্থিক সহায়তাসহ নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে আসছে এবং সেটা আরও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়াও অব্যাহত রেখেছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, যখন বৃহৎ শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই করছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারও রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার দিকে মনোনিবেশ করছে, তখন সাধারণ মানুষের চাহিদা ঠিক কী সেদিকে কারও মনোযোগ নেই।