যেকোনো মুহূর্তে কয়লার অভাবে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। কোনো পক্ষ থেকেই কোনো ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের অভিযোগ ওঠার আগেই শুধু হিসাব-কিতাবের ব্যর্থতায় বকেয়া দেনা মেটাতে না পারার সংকটে সবার চোখের সামনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল এই আধার। এমন বাস্তবতার একদিন আগে লিখিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদকে জানালেন, দেশে এ অবধি আবিষ্কৃত পাঁচটি ক্ষেত্রের মজুদকৃত কয়লার পরিমাণ প্রায় সাত হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে কেবল বড় পুকুরিয়া খনির উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক আট লাখ মেট্রিক টন।
কী দাঁড়ালো বিষয়টা! কোথায় সাত হাজার মিলিয়ন টন আর কোথায় আট লাখ!
দেশের কয়লাক্ষেত্রগুলোর আবিষ্কার ১৯৬২ থেকে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। ফলে সব অর্থমন্ত্রীই মাটির নিচে পড়ে থাকা এই বিশাল মজুদের হিসাব দিতে পছন্দ করেন। আর পায়রার মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় বিদেশ থেকে আনতে না পারা কয়লার-ই অভাবে। একইভাবে গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্র আর অন্যদিকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে দুর্বল করে রাখার বাস্তবতাটাও প্রায় কাছাকাছি।
আরো বাস্তবতায় ফিরে আসি, গ্যাসের পরে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের দ্বিতীয় সাশ্রয়ী কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে যে কয়লা প্রয়োজন তার মজুদ ফুরিয়ে গেছে। ফলে ঘন বাষ্পের আঘাতে টারবাইন ঘোরা বন্ধ হবে আজ যেকোনো সময়। ৬৬০ করে দুটি ইউনিটে বিভক্ত মোট এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার একটি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে ২৫ মে। আজ বন্ধ হয়ে যাবে অবশিষ্ট ইউনিটও। অথচ প্রায় ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকায় নির্মিত এখনো নতুনের মোড়কে চলা পায়রার পথচলা বাণিজ্যিকভাবে চালু হবার পর একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।
তেলভিত্তিক অতি খরচের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুইক রেন্টালের বিপরীতে এক বড় আশার আলো হয়ে এসেছিল সর্বোচ্চ আট টাকা ইউনিট খরচের, শান্তির এই পায়রা। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ মালিকানায় বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এর পরিচালনা করে। দেশীয় অংশের প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, কয়লার সংস্থান হলে এ মাসের শেষের দিকে আবারো পায়রার সুউচ্চ চিমনী থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হবে, অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে।
পায়রা ছাড়া এই এক মাস এই গরমে বিদ্যুতের কী পরিণতি হতে পারে তাই নিয়ে চলছে নানা শঙ্কার আলোচনা। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোদমে চালাতে দৈনিক গড়ে কয়লা প্রয়োজন দশ হাজার টন। বছরে ৩৬ থেকে ৪০ লাখ টন। ডলার সংকটের কারণে গত ছয় মাস কয়লা ক্রয়ের বিপরীতে কোনো টাকা না দেয়ায় বাকি পড়েছে ২৯ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বলেছে, টাকা না দিলে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আনা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারিতে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে। একই বছরের ২৬ আগস্ট দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে। দেশে এখন ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয় প্রায় ৩০ টাকা, ফার্নেস তেলে ১৪ টাকা ও কয়লায় সাত থেকে আট টাকা। সবচেয়ে কম ব্যয় গ্যাসে, ইউনিটপ্রতি মাত্র চার টাকার মতো।
অর্থমন্ত্রী তার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লিখিত বাজেট বক্তব্যে যে পরিমাণ কয়লার কথা বলেছেন তাতে দেশের ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু সেই কয়লা উত্তোলনের সক্ষমতা যেমন আমাদের নেই, তেমনি তার অভিঘাত মোকাবেলাও অসম্ভব। তার থেকেও বড় বাস্তবতা, বড় পুকুরিয়ায় যেখানে ওই সামান্য কয়লা ওঠানো হয় সেখানেও ব্যবস্থাপনার অভাবে কয়লা চুরির খবর আসে, উধাও হয়ে যাওয়ায় পর কখনো কখনো ওই কেন্দ্রটিও বন্ধ হবার অতীত বেশিদিন আগের নয়।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের কয়লাক্ষেত্র থেকে কয়লা সংগ্রহের কারিগরী ও অন্যান্য সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। দেশে যে ৫টি কয়লাক্ষেত্র আছে সেগুলোর মধ্যে বড় পুকুরিয়াতে আছে সবচেয়ে কম, মোট ৪১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এরমধ্যে শুধু দিনাজপুরের এই খনি থেকে এতোদিন ধরে সাড়ে ১৩ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। দীঘিপাড়ায় আছে ৭০৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন, মাটির ৩২৮ থেকে ৪৫৫ মিটার নিচে হওয়ায় সেই কয়লা তোলার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। একইভাবে ফুলবাড়ীর ৫৭২ বা খালাসপীরের ৬৮৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার স্তরও অনেক নীচে। সবচেয়ে বেশি কয়লা জামালগঞ্জের মাটিতে। তবে কমপক্ষে ৬৪০ মিটার নিচ থেকে শুরু ওই কয়লার স্তরে মিলেছে পাঁচ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা যা না তুলে গ্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে সেই খনিজ ব্যবহারের আলোচনা বিশেষজ্ঞ মহলে অনেক আগে থেকেই চলছে।
আবার আসি গ্যাস প্রসঙ্গে। অর্থমন্ত্রীর দেয়া মোট কয়লার হিসাবের সাথে প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনা করা হলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ১৮৫ টিসিএফ। আমাদের দেশে যে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আছে তাতে মোট গ্যাসের পরিমাণ ৪০ দশমিক ২৩ ট্রিলিয়ন। এরমধ্যে উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত ২৮ দশমিক ৬২। যার মধ্যে তুলে ফেলা হয়েছে ১৯ দশমিক ৯৪। এই জানুয়ারির হিসেবে বাকি আছে আর মাত্র ৮ দশমিক ৬৮ টিসিএফ। এই গ্যাসের শতকরা ৪০ ভাগ বিদ্যুতে আর বাকি সারকারখানা, শিল্পে, বাণিজ্যে, ঘরে এমনকি গাড়ি চলার সিএনজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাজেট বইয়ের সাথে দেয়া বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, এক বছরে গ্যাসের ব্যবহার হয় মোট ৮৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে যে গ্যাস এখন পর্যন্ত প্রমাণিত তা আর চলবে সর্বোচ্চ দশ বছর। অর্থমন্ত্রী অবশ্য তার বক্তৃতায় জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে উন্নীত করার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এলএনজি, ফার্নেস অয়েল এর ওপর নির্ভরতা বাড়ছে ভবিষ্যতে।
অবশ্য নতুন করে ভোলায় কিছু গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত হলেও ভোলার গ্যাস ব্যবহারে সক্ষমতার ঘাটতি ছিলো। ফলে ২০২৩ এ এসে দেশের স্থলভাগে ভোলা এখনো আশার আলো দেখাতে পারে বলেই মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : বোরহানুল হক সম্রাট, প্ল্যানিং এডিটর, দৈনিক আমাদের বার্তা