বাণিজ্যিকীকরণ থেকে বেরিয়ে আসুক শিক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

বাণিজ্যিকীকরণ থেকে বেরিয়ে আসুক শিক্ষা

অলোক আচার্য |

নতুন কারিকুলামের একটি উদ্দেশ্য হলো শিশুদের ওপর থেকে পরীক্ষার চাপ কমানো। চাপ কমিয়ে তাদের পড়ালেখা ভীতি বা বিরক্তি দূর করা। বহু বছর ধরে আমাদের দেশের শিক্ষা তার মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মনুষ্যত্ব অর্জন হলেও শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছিলো একটি চাকরি এবং ফলাফলভিত্তিক ব্যবস্থায়। প্রচুর পড়তে হবে, কোচিং করতে হবে, প্রাইভেট পড়তে হবে এবং এ প্লাস পাওয়ার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হবে। এই হলো এখন পড়ালেখার লক্ষ্য! এখনো সে পরিস্থিতি রয়েছে। এখান থেকে বের হতে হবে। দেশে সরকারি ও এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে এবং তারা শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে এসব কিন্ডারগার্টেনগুলোতে।

তারা ভালো ফলাফলও করছে। এসব কিন্ডারগার্টেগুলোতে আবার ফি ভিন্ন ভিন্ন। নামীদামি (ফলাফলের ভিত্তিতে) কিন্ডারগার্টেনগুলোতে খরচ বেশি। অর্থাৎ তাদের প্রতিযোগিতাও বেশি। কিন্তু প্রতিযোগিতার সঙ্গে টিকতে গিয়ে অতিরিক্ত বই, পরীক্ষার চাপ এবং ভারী ব্যাগ এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার স্বাভাবিক পরিস্থিতি ক্রমেই নষ্ট হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝে গেছে, ভালো ফল করার পন্থা এটাই। নাক-মুখ গুঁজে পড়তে হবে, কোচিং করতে হবে। অভিভাবকরাও এটি মেনে নিয়েছেন। কারণ, তাদের বিশ্বাস তার সন্তান যতো বেশি পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকবে, প্রাইভেট, কোচিং করবে ততো বেশি সে শিক্ষিত হবে এবং তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল! এজন্যই শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে গেছে ফলাফল নির্ভর। শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার এবং আমাদের দেশে বহু ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে অন্যসব খরচের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকহারে বেড়েছে শিক্ষা উপকরণেরও মূল্য। এর সঙ্গে সন্তানের প্রাইভেট, কোচিং ইত্যাদি খরচ সামলাতে একটি সাধারণ পরিবারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা গ্রহণ করছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার প্রসারে, মানসম্মত শিক্ষাদানে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। 

আর এসব কিন্ডারগার্টেনগুলো আছে বলেই প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশে লেখাপড়া করতে পারছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার শুরু থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত রয়েছে। এসব অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ফি, বেতন ইত্যাদি আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। বছরের শুরুতেই সেশন ফি, বেতন সব মিলিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এটা এক ধরনের বাণিজ্য। যদিও শিক্ষা এখন বাণিজ্যই হয়ে যাচ্ছে! এই টাকা পরিশোধ করতে রীতিমতো নাজেহাল হতে হয় নিম্নআয়ের পরিবারের কর্তাদের। তবে যত্রতত্র এসব কিন্ডারগার্টেন গড়ে ওঠায় সেখানে কারা শিক্ষা দিচ্ছে, তারা কীভাবে নিয়োগ পাচ্ছেন বা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কতোটুকু এবং তাদের শিশুদের পড়ানোর যোগ্যতাই বা কতোখানি তার পরিমাপ করার কোনো উপায় থাকছে না। কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তই এক্ষেত্রে চূড়ান্ত। কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন এতো কম যে তা উল্লেখযোগ্য নয়। তবুও তারা চাকরি করছেন, শিক্ষা দিচ্ছেন। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান কতৃপক্ষের কমই নজদারিতে রয়েছে। তবে গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে যেখানে ইচ্ছে করলেই কিন্ডারগার্টেন বা কোনো বেসরকারি স্কুল পরিচালনা করা যাবে না সরকারি অনুমোদন ছাড়া। ইচ্ছেমতো বই দেওয়া যাবে না এবং ফি আদায় করা যাবে না। বর্তমান থাকা ৫৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিকে নিবন্ধন নিতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো প্রতিষ্ঠান পূর্ব অনুমোদন ছাড়া পরিচালনা করা যাবে না। জানা গেছে, এরকম নানা বিধান রেখে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) নিবন্ধন বিধমালা তৈরি করছে সরকার। বিধিমালায় শিক্ষক নিয়োগ, পরিচালনা কমিটিসহ প্রতিটি বিষয়েই বিধির উল্লেখ রয়েছে। এটি চূড়ান্ত এবং বাস্তবায়িত হলে তা শিক্ষায় একটি গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থেকে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। কারণ, যেখানে ইচ্ছে সেখানে কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে।

শিক্ষা একটি সেবা এবং এই দৃষ্টিকোণেই তা পরিচালিত হতে হবে। কারণ, প্রতিবছর অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। সামান্য দূরত্বে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সত্যিই সেখানে এতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন আছে কি না কেউ খোঁজ নেয়ার নেই। যেখানে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর অতিরিক্ত পড়ার চাপ দেয়া হচ্ছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের ভালো মান হলেও খরচের চিন্তায় সেখানে লেখাপড়া করানো কঠিন হয়ে যায় অভিভাবকের জন্য। অথচ বছরের শুরুতেই সেই চাপ নিতে হয়। বছর বছর ফি’র পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পায় তার সঙ্গে বৃদ্ধি পায় ফি’র আওতা। নানা ধরনের ফি যোগ হচ্ছে। তবে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে সমানভাবে ভালো পরিবেশ বজায় রাখতে পারছে তা নয়। আবার দক্ষ শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রসারের কাজটি ভালোভাবেই করে চলেছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষাখাত এগিয়ে নিতে মানসম্মত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত কর্মরত রয়েছে লাখ লাখ শিক্ষক। এর সঙ্গে রয়েছে কর্মচারী। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থানেরও একটি বড় উৎস এসব কিন্ডারগার্টেন। কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করেই বহু পরিবার চলছে। অথচ খুব সামান্য বেতনেই তারা চাকরি করছেন। তাদের অর্থ আয়ের মূল উৎস হলো প্রাইভেট। শিক্ষার মূল কাজটি তারা নিরলসভাবে করছেন। দেশে অলিতে গলিতে গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন। তাদের সবার শিক্ষা মান যে সমান তা নয়। সব প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি এবং অন্যান্য ফি আদায়ের পরিমাণও সমান নয়। দেশের এসব বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু রয়েছে। অনেক বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন, পরীক্ষার ফি ও অন্যান্য ফি প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন নেয়া হয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি অনেক বেশি। যে ব্যয় বহন করা সাধারণ পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে শিক্ষা দিতে সব অভিভাবকই চায়। 

শিক্ষা প্রদান একটি সেবামূলক কাজ হলেও বিষয়টি আজ রীতিমত বাণিজ্যিক একটা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। একটি প্রতিযোগিতা চলছে এবং সেটি শুভ নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা খারাপ নয়, খারাপ হলো যখন তা একটি সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। শিক্ষা এবং বাণিজ্য পাশিপাশি চলতে পারে না। এখান থেকে শিক্ষাকে বের করে আনতে হবে। শিক্ষা একটি সেবা। এর মধ্যেই শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। শিক্ষা মূল উদ্দেশ্য অর্জনে ব্রতী হতে হবে। আমাদের দেশে কয়েক বছর আগে থেকেই শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ভালো ফলাফল করার আশ্বাসেই অনেক প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করছে। মূলত মানসস্মত শিক্ষার চেয়ে ভালো ফল করানোই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য তাদের। এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটা প্রতিষ্ঠানের গা ঘেঁষে আরেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই কেবল একটি বিশাল বিল্ডিং ভাড়া করে গড়ে উঠছে। সেখানেই রয়েছে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শাখাও! এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটাই লক্ষ ভালো ফল করানো। ভালো ফলের জন্য অভিভাবকদের কাছেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা রয়েছে। তারা যেকোনোভাবে সন্তানকে এখানে পড়াতে চান। ভালো ফলের জন্য রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানেই আবার রয়েছে আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা। সেখানেও রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়। টিউশন ফি, কোচিং ফি এবং অন্যান্য ফি মিলিয়ে মাসে মোটা টাকা গুণতে হয় অভিভাবককে। এখন যারা সেখানে পড়ছে তারা চাপ হলেও ভালো পড়ার জন্য পড়তে বাধ্য হচ্ছে। 

লেখক : অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0065500736236572