দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলসহ দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা পানির নিচে ডুবে গেছে। স্মরণকালের এ চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন লাখ লাখ বানভাসি পরিবার। চলমান এ বন্যায় শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিসেফের (জাতিসংঘের শিশু তহবিল) তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৫ লাখের বেশি শিশু ধ্বংসাত্মক বন্যায় করুণ পরিণতির সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। অনেক শিশু বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। প্রায় ৮ জন শিশু মারা যাওয়ার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেলেও প্রকৃত চিত্র খুবই করুণ।
চলমান বন্যায় ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ খাদ্যের সংকটে ভুগছে হাজার হাজার শিশু। ক্ষুধার যন্ত্রণায় বানভাসি শিশুরা কাঁদছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে শিশুদের। বন্যায় ত্রাণ পাওয়া গেলেও শিশুদের জন্য আলাদাভাবে কেউ সেভাবে চিন্তা করে না। ফলে ক্ষুধায় শিশুদের কষ্ট বাড়ে। এ সময় বিশুদ্ধ পানির অভাবে শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া নিউমোনিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বন্যার সময় শিশুদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো, বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা। চলমান বন্যায় কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা পানিতে ডুবে দুজন শিশু মারা গেছে। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় পানিতে ডুবে একজন, কক্সবাজারের চকরিয়ায় একজন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে একজন ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় একজন শিশুসহ বিভিন্ন স্থানে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অনেক শিশু নিখোঁজ রয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা একবারেই ভেঙে পড়ে। অন্যের সাহায্যের অপেক্ষায় থাকে তারা। অনেক শিশু মানসিকভাবে ভয়ের মধ্যে দিন পার করে। এ সময় পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা বেশি দরকার হয়। দুর্যোগে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিতে আছেই, তার সঙ্গে রয়েছে শিক্ষার ক্ষতি। বন্যার সময় ও বন্যা পরবর্তী পরিবারের আর্থিক ক্ষতিও শিশুর জীবনে পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। বন্যার সময় শিশুর নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। শিশুদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দূরীকরণে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বন্যার সময় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা একাকার হয়ে যায়। শিশুদের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এ সময় শিশুর পানিশূন্যতা দূর করার জন্য খাবার স্যালাইন দরকার হয়। অনেক শিশু অপুষ্টি ও মারাত্মক পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ ছাড়া উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাই এ সময় শিশুদের সুস্থ ও নিরাপদে রাখার দিকে সর্বোচ্চ নজর কাম্য।
গত মে-জুন মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এ শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। তখন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। এর মধ্যে প্রায় ৩২ লাখ শিশু রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছিলো ইউনিসেফ (জাতিসংঘের শিশু তহবিল)। এবারের বন্যায় উদ্ধার তৎপরতা বেশ ভালো ছিলো। তবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সমন্বয় থাকলে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ বিতরণে আরো গতি আসতো। শিশুদের কথায় বিবেচনায় রেখে ত্রাণ বিতরণে শিশু খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, শিশুদের হাতে ত্রাণ দেয়ার সময় কোনো প্রকার ছবি তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিশুদের কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে হবে সবার আগে। বন্যাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে গর্ভবতী মা ও সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশু ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের উদ্ধারে গুরুত্ব দিতে হবে। কেনোনা ক্ষুধায় কাতর শিশুদের কষ্ট সহ্য করা প্রায় অসম্ভব। বন্যা বা যেকোনো দুর্যোগের আভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের শুকনো খাবারসহ দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। একটু সচেতনতাই পারে বন্যার পানিতে শিশুমৃত্যু রোধ করতে। শিশুরা সুরক্ষিত থাকলেই আগামী প্রজন্ম এগিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষক