পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যেকোনো পেশায়ই প্রশিক্ষণ একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। এই প্রশিক্ষণ দেশে ও বিদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানকালে বিষয়টি হয়েছে যতোটা না পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য তার চেয়ে ঢের বেশি হচ্ছে অর্থ কামানো, সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি আর দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, সঙ্গে থাকে বাজারঘাট করা। সব পেশাতেই কমবেশি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এসব প্রশিক্ষণে যাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি যারা বিভিন্ন কারণে এইসব সুবিধা অর্জন করতে পারেন সেটি বেশি বিবেচ্য। বিশেষ করে যেসব প্রশিক্ষণের অর্থ প্রাপ্তির বিষয় জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে থাকেন--সেটি প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, তদবিরের বলে কিংবা ক্ষমতার বলে করে থাকেন। কারণ, বিষয়টি যেহেতু অধিকাংশ তাদের হাতেই থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশিক্ষণের খবর তো মন্ত্রণালয়গুলোতেই আসে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই বণ্টন করেন, সিদ্ধান্ত নেন কে কোথায় কীভাবে যাবেন।
বিভিন্ন পত্রিকায় আগে দেখতাম, প্রথম চেষ্টা থাকে তারা নিজের কোনো না কোনোভাবে এইসব প্রশিক্ষণে যাবেন। নিজেরা কোনোভাবে যেতে না পারলেও তাদের পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন তাদের পাঠানোর জন্য ব্যস্ত থাকেন এবং পাঠিয়ে থাকেন। সেটি প্রাসঙ্গিক হোক আর অপ্রাসঙ্গিক হোক। আমাদের দেশে শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এইসব প্রশিক্ষণে যা তারা শেখেন বা শেখানো হয় তার কোনো হদিস মেলেনা তবে যেখানে অর্থ আছে সেখানে তারা যাবেন। অর্থ নেই, আপনার যতো প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণই হোক না কেনো আপনি তাদের পাবেন না। ফলে, প্রশিক্ষণের ব্যাপারটিই হয়েছে, বিকল্প পথে কিছু কামানো। পেশাগত উন্নয়নের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, প্রশিক্ষণের বিষয় আপনি জানতে চাবেন তারা তেমন কিছু বলতে পারেন না। ফলে যেটি হয়েছে, একটি বিশেষ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা কিংবা উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মকর্তারা যখন দেশে আসেন, তখন তাদের এমনসব জায়গায় পদায়ন করা হয় যার সঙ্গে প্রশিক্ষণ, উচ্চতর জ্ঞান বা বিদেশে ভ্রমণ কোনটিরই কোনো মিল থাকেনা। এটির জন্য কে দায়ী? যিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি, নাকি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাকি পুরো সিস্টেম? যেই দায়ী হোন না কেনো, বিষয়টি বুঝা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয়ে কর্মকর্তাদের যে প্রশিক্ষণ কিংবা উচ্চশিক্ষা দেয়া হলো তা রাষ্ট্রের, জনগণের কিংবা কোনো বিশেষ বিভাগের কোনই কাজে আসেনা। পুরো বিষয়টি তার গুরুত্ব একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে।
আমরা ইদানিং মিডিয়ায় এ ধরনের কিছু উদাহরণ দেখতে পেলাম। থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এআইটি) থেকে জ্বালানি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন উপসচিব মোহাম্মদ যিনি অষ্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে করেছেন এমএ। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে এমবিএ করেছেন। দায়িত্ব পালন করছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে। পরে তাকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বদলি করা হয়। গত বছরের শেষ দিকে উক্ত উপসচিবকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পদায়নের অনুরোধ জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি দেন অর্থসচিব। তিনি এখন অর্থ বিভাগের বাজেট শাখায় কর্মরত। অর্থ সচিবের উদ্যোগে তিনি উপযুক্ত স্থানে পদায়ন পেলেও অনেক কর্মকর্তা রয়েছে যাদের উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে পদায়ন সম্পর্কযুক্ত নয়। সরকারের অর্থ ব্যয় করে নেয়া শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যাচ্ছে বিফলে, কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারছেন না কর্মকর্তারা। কারণ, এখানে ধরা, করা, পরিচিতি এবং কার আত্মীয় ইত্যাদি বিষয় জড়িত।
জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফল পলিসি স্টাডিস থেকে লোকপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন একজন যুগ্মসচিব। দারিদ্র্য নরিসনের ওপর তার রয়েছে বিশেষ জ্ঞান। এ বিষয়ে গবেষণাও রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এমডিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক পলিসি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন অন্য একজন উপসচিব যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও রয়েছে। দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক (পরিমাণগত পদ্ধতি) হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ থেকে এমবিএ করেছেন অন্য একজন উপসচিব। এ ছাড়া উক্ত উপসচিব যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাডফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমএসসি করেছেন ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফিন্যান্স ফল ভেভেলপমেন্ট বিষয়ে। এখন দায়িত্ব পালন করছেন আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) উপ-প্রকল্প পরিচালক হিসেবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব জাপানের ইয়ামগুচি ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিষয়ে এমএ করেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব গ্রিনউইচ থেকে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ফিনান্সে এমবিএ করেছেন। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের উপসচিব (সংযুক্ত) হিসেবে। অন্য এক কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে এমএসসি ডিগ্রি নিয়েছেন। কর্মরত আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয় দেশের বাজেট প্রণয়নসহ অর্থ সংশ্লিষ্ট নানা কাজ করে। ফলে যাদের লেখাপড়া ও প্রশিক্ষণ অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট তাদের পক্ষে গুণগত মান রক্ষা করে এ বিভাগের কাজগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব। এসব বিবেচনায় নিয়ে কাজের সুবিধার্থে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে যোগ্য কর্মকর্তা চায় অর্থ বিভাগ, কিন্তু সাড়া মেলেনি। সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার চলমান সংস্কার অব্যাহত রাখার স্বার্থে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উদ্ভূত নানামুখী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রায়োগিক অর্থনীতি, উন্নয়ন অর্থনীতি এবং পাবলিক ফিন্যান্স বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনকারী কর্মকর্তাদের অর্থ বিভাগে পদায়ন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা ব্যবহার করে দেশের উন্নয়ণ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা এবং টেকসই করাও জরুরি। একইভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজন কুটনৈতিক জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক ভাষায় কার্যকরী দক্ষতা। এসব বিবেচনায় না নিয়ে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানের কোনো একটি বিষয়ে নম্বর ভাল প্রাপ্তির কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্যাডারে তার চাকরি হলো। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যারা আছেন তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বিদেশে মার্কেট সৃষ্টি করা, বিদেশে দেখতে যাওয়া আর বসিং করা নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এসব অর্জিত হয়না। ফলে, আমরা বিদেশের দীর্ঘদিনের মার্কেটও হারিয়ে ফেলি, ধরে রাখতে পারি না।
কোরিয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে যোগ দেয়ার কথা ছিলো ১৫৭জন চিকিৎক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর। তবে দেশে ফিরে ৭২জন যোগ দিলেন, বাকী ৮৫জনই যোগ দেননি। কেউ কেউ মোটা টাকা ভাতা পাওয়ার আশায় তদবির করে গিয়েছিলেন। এ ছাড়াও একজন সহকারী কন্ট্রোলার নারী সহকর্মীর সঙ্গে ফুর্তি ও অরেকজন সহকারী পরিচালক দোকানে চুরি করে ধরা পড়েন। প্রয়োজন ছাড়াই অনেকে প্রশিক্ষণ নিতে কোরিয়ায় যান। জানা যায়, সুপার স্পেশালাইজড হাসাপাতালে যোগ দেয়ার শর্তে বিএসএমএমইউর ১৫৭ জন চিকিৎক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ২ থেকে ৪ মাসের প্রশিক্ষণে দক্ষিণ কোরিয়া যান। তাদের মধ্যে ৫২ জন চিকিৎক, ২৯ কর্মকর্তা, ৫৩ জন সিনিয়র নার্স ও ২৩ জন টেকনিশিয়ান। প্রশিক্ষণ শেষে ৬ চিকিৎক, ৫ কর্মকর্তা, ৫০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স ও ১১ জন টেকনিশিয়ানসহ ৭২ জন যোগ দিয়েছেন, ৮৫ জন যোগ দেননি। যদিও তাদের প্রত্যেককে দৈনিক ৭৫ ডলার ভাতা দেয়া হয়েছে। এ হিসেবে যারা ২ মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা একেকজন সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আর যার ৪ মাস ছিলেন তারা ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন। তাদের যাতায়াত, হোটেল ভাড়া, খাওয়া প্রভৃতি খরচ মিলিয়ে আরো কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই প্রশিক্ষণে অনেক অপ্রয়োজনীয় লোকও অংশ নিয়েছেন, যাদের প্রশিক্ষণ কোনো কাজে আসছে না, এ কথা বলেছেন স্বয়ং প্রক্টর।
এসব অনিয়মের বিষয়ে একজন সাবেক সচিব বলেন, যোগ্য জায়গায় যোগ্য ব্যক্তিকে বসানোর ক্ষেত্রে একটাই প্রতিবন্ধকতা, তা হলো সুশাসন নেই। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদের সময় পর্যন্ত কিছুট হলেও মানা হতো, যে যোগ্য তাকে তার উপযুক্ত জায়গায় দেয়া হতো। স্বৈরাচার বলেন, আর যাই বলেন, মোটামুটি সিভিল সার্ভিসে দলীয়করণ ছিলো না। কিন্তু ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দলীয়করণ শুরু হলো। তখন থেকে আর যোগ্যতা ও অযোগ্যতার প্রশ্ন নেই। ও আমার লোক, তার নামের পাশে অমুক দলের সিল আছে, সুতরাং তাকে ভালো পোস্টিং দাও। সে পদার্থ, কী অপদার্থ সেটা ভাবার দরকার নেই। সরকার আর দল একাকার হয়ে গেছে। প্রশাসনের মানুষগুলোও বুঝে গেছে, দল করলে মজা আছে। শুধু ভাল পোস্টিং না, মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া যায়। বছরের পর বছর সেই মেয়াদ বাড়ানো যায়। কয়েক সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ একই কথা বলছেন, ‘প্রশাসনে উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত ব্যক্তিকে পদায়নের মূল অন্তরায় রাজনীতিকরণ। এখন পদায়ন হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। দলীয় আনুগত্য না হলে যতোই যোগ্য হন ভালো পদায়ন পাওয়া যায় না। অনেকের যোগ্যতা না থাকলেও তদবিরের জোরে বাগিয়ে নিচ্ছেন ভালো পদ। এখন যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন হয় না। কে সরকারের আদর্শে বিশ্বাসী, কার তদবিরের জোর কতো-পদায়ন হয় তার ওপর ভিত্তি করে। এটাই হচ্ছে সমস্যা। রাজনৈতিক বিবেচনা উঠে গেলেই যোগ্যতা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদায়ন সম্ভব হবে।’ রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থকে কবে আমরা দল ও ব্যক্তির ওপর স্থান দিতে পারবো জানি না। তবে সেটি করতে না পারলে আমরা সুস্থ ও জনবান্ধব কোনো প্রশাসন আশা করতে পারি না।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক