কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি স্কুলটিকে অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারীতার আতুরঘরে পরিণত করেন। এমনকি স্কুলের বিজ্ঞানাগারে নিজ স্বামীর বিশ্রামের জন্য তৈরি করেছেন বিশ্রামাগার।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুরে স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় বিজ্ঞান ল্যাবের ভিতর ব্যবহারিক উপকরণ রাখার আলমারি দিয়ে পার্টিশন বানিয়ে নিজ স্বামীর জন্য তৈরি করেছেন বিশ্রামাগার। সেখানে বিছানা পেতে পাশে রাখা হয়েছে টেলিভিশন ও আলনা এবং স্ট্যান্ড ফ্যান। শিক্ষক মিলনাতয়নের পাশেই তৈরি করা হয়েছে রান্নাঘর। রান্নাঘরে ফ্রিজ, গ্যাসের চুলা, রাইচকুকার, সোকেস প্লেট-বাটি-গ্লাস সবই আছে।
স্কুলের সহকারী শিক্ষক ও আয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীনের পৈত্রিক নিবাস গোপালগঞ্জে। তার স্বামীর বাড়ি লালমনিরহাট জেলা সদরে। লালমনিরহাট থেকে প্রাইভেট কারে করে স্বামী রেজাউল করিমসহ নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করতেন রুখসানা। স্কুল যেন তাদের দ্বিতীয় সংসার।
স্কুল চলাকালীন তার স্বামী দিনভর স্কুলে থাকতেন। বেশিরভাগ সময় তার স্বামী বিজ্ঞানাগারে তৈরি করা বিশ্রামাগারে অবস্থান করতেন।
এই দম্পতির জন্য স্কুলে তৈরি করা রান্নাঘরে নিয়মিত দুপুরের খাবার রান্না করা হয়। বাজারের জন্য পিয়ন এবং রান্নার কাজে স্কুলের আয়াকে নিয়োজিত করা হয়েছে। শুধু দুপুরের রান্না নয়, বাড়ি ফিরে রাতের রান্নার উপকরণ স্কুলের রন্ধনশালা থেকেই প্রস্তুত করে নিয়ে যান প্রধান শিক্ষক।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারীতা, ‘স্বৈরাচারী আচরণ’ এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ তুলে তাকে অপসারণের দাবি ওঠে। স্কুলটির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা গত দুইদিন ধরে স্কুলে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও দিনভর আন্দোলন করেছে তারা। এদিন বিকালে স্কুলের প্রশাসনিক ভবনসহ বিভিন্ন কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে সকল ধরণের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আচ করতে পেরে গা ঢাকা দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক রুখসানা পারভীন। গত দুই দিনধরে তিনি স্কুলে অনুপস্থিত।
স্কুলটির সহকারী শিক্ষকরা বলছেন, ‘স্কুলটি একদিকে প্রধান শিক্ষকের প্রমোদখানা, আরেক দিকে যেন দ্বিতীয় হারুনের হোটেল! কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে স্কুলে একরকম ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছেন প্রধান শিক্ষক। তিনি বেপরোয়াভাবে স্কুল পরিচালনা করছেন। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় তিনি সবসময় শিক্ষকদের থ্রেটের ওপর রাখতেন। বদলির ভয় দেখাতেন। ফলে ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না।’
শিক্ষকরা আরো বলেন, ‘গত ১৫ বছরে প্রধান শিক্ষক স্কুল ফান্ডের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাত করেছেন। ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেছেন জেলার কিছু সাংবাদিক নেতা ও রাজনীতিক। স্কুল শিক্ষার্থীদের অন্দোলনের পর শিক্ষকরা সাহস ফিরে পেয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তবে প্রধান শিক্ষক স্কুলে আসছেন না। তিনি ছুটির আবেদন দিলেও তার ছুটি মঞ্জুর হয়নি।’
স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ( প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত) তুষার কুমার রক্ষিত বলেন, ‘স্কুলের ভিতর স্বামীর জন্য বিশ্রামাগার আর রন্ধনশালা তৈরি বিধিসম্মত নয়। কিন্তু আমাদের সবার মুখ এতোদিন বন্ধ ছিল। আমাদের কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। বিষয়টি আমরা জেলা প্রশাসক ও উপপরিচালককে লিখিত আকারে জানিয়েছি।’