বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন একবার এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের ফাঁকে বলছিলেন, ‘‘আমার কাছে তথ্য আছে, বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসিকে ঘুষ দেয়া হয় এটা বলার জন্য যে, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিপিসির কাছে জ্বালানি তেল চাওয়া হলেও তারা সেটা দিতে পারেননি।’ আমি বললাম- ‘স্যার, এটা ঘুষ দিয়ে বলাতে হবে কেনো, এমনিতেই তো বলা যায় যদি ঘটনা সত্যি হয়।’ তিনি বললেন, ‘এই যে বললেন, যদি সত্যি হয়।’ আমি বললাম, ‘মিথ্যা করে বললেও এ কথায় ঘুষ দিতে হবে কেনো।”
ড. জাহিদ বললেন, “একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি যদি তেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারে তাহলে সরকারকে পেনাল্টি বাবদ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। ফলে কেন্দ্র চালু রাখার বদলে বন্ধ রাখা হলেও অনেক সময় লাভ হয়। আর বিপিসির নির্দিষ্ট শাখা যদি বলে তারা তেল চেয়েছিল, কিন্তু আমরা দিতে পারি নাই-তাহলেই প্রতিদিনের বন্ধ কেন্দ্রের ওই ক্যাপাসিটি চার্জ পাওয়া শুরু হবে।”
বলা প্রয়োজন, গত ১২ বছরে এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছ থেকে বিদ্যুৎ না কেনায় তা বন্ধ থাকার কারণেই চুক্তি অনুযায়ি সরকারকে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
আবার ফিরি ড. জাহিদের কাছে। যেহেতু এটা সাক্ষাৎকারের বিরতিতে তিনি বলেছেন। আর আমার এটার ভিডিও লাগবেই। তাই ক্যামেরায় তাকে এটা বলতে ফের অনুরোধ করলাম। তিনি একটু ভাবলেন এবং একটু ঘুরিয়ে একই কথা বললেন, অন ক্যামেরায়, ‘আমি এমন খবরও শুনেছি যে…।’
গত ৫ জুন দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা বন্ধ হবার পর ড. জাহিদের সেই কথাটা বার বার মনে হচ্ছে। ঘুষ দিয়ে বলতে বলা যে তেল নেই। দেশের প্রতিথযশা শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম, অধ্যাপক বদরুল ইমাম ও অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তারা চোখ রাখছেন আন্তর্জাতিক কয়লা ও তেলের বাজারে। একটি সহযোগী দৈনিক পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে তারা জানিয়েছেন, টনপ্রতি প্রায় ৩৫০ ডলারে উঠে যাওয়া কয়লা এখন নেমেছে ১৫০ ডলারেও। অভাব নেই কয়লার। ১২০ ডলারে পৌঁছে যাওয়া ক্রুড ওয়েল এখন ঠেকেছে ৭০ ডলারে। অভাব নেই তেলেরও। আর অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, অভাব আসলে টাকার। আমাদের টাকা বা ডলার দুটোরই অভাব এখন অনেক। তিনি মনে করেন, আমদানি নির্ভর বিদ্যুৎখাতের ব্যবস্থাপনা আর পরিকল্পনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, পড়েছে বিপর্যয়ের মধ্যে।
ড. ম তামিমের শঙ্কা এবার বন্ধ অর্থাৎ অলস বসে থাকার কারণে পায়রাকে গুণতে হতে পারে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ। পিডিবি ও বিসিপিসিএল এর কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের ধারণা দিয়েছেন, যদি টানা ৩০ দিন অলস বসে থাকে পায়রা তাহলে কেন্দ্রভাড়া বাবদ ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হতে পারে। এর বাইরে বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, বিসিপিসিএলকে লাভের বদলে লোকসান গুণতে হবে ৩০ কোটি টাকা। ড. জাহিদের কথা আবার মনে পড়তে পারে পাঠক আপনার। কারণ না চললেও তো লাভ। কিন্তু কার লাভ? ধারণা করি, এবার সেই খতিয়ানের দিকে আলাদাভাবে নজর রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়া হলেও মাত্র ১০ কোটি ডলারের (যা দিয়ে অবশেষে কয়লা আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে) অভাবে বা অব্যবস্থাপনায় পায়রার বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তীব্র গরমের মধ্যেও সারাদেশে নেমে আসা বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঠেকানো যায়নি।
ড. জাহিদকে আমি ফোন দিতে এবার ভয় পেয়েছি। যদি তার কাছে ৫ জুন থেকে পায়রার উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পেছনের কোনো গল্প শুনতে হয়। যদি প্রায় ১০ মাস ধরে পায়রাকে বাঁচিয়ে রাখা কয়লার কোনো মূল্য শোধ না করার পেছনে ডলারের সংকট বা গাফিলতি বা সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি আর কোনো খবর মেলে। অজানা ভয়ে তাই ফোন করি না এই অর্থনীতিবিদকে।
শুধু পায়রা কেনো, এ মুহূর্তে বন্ধ হয়ে আছে আরো প্রায় ৫০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মোট ১শ ৭০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৬২টি কেন্দ্রও তার যা ক্ষমতা তার থেকে অনেক কম উৎপাদন করছে জ্বালানির অভাবে। পায়রা বড় বলে পায়রার আলোচনা চলছে বেশি করে। কিন্তু ছোট ছোট কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ কিন্তু বসে নেই। পায়রা বন্ধ হবার আগের ইতিহাস বড় করুণ। শুধু গত ৩ বছরের পরিসংখ্যান জানতে চান। সেটাও ভয়াবহ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি আর ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। ৩ বছরে বেসরকারি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল-আমদানি করা বিদ্যুৎ ও আইপিপিকে এ বাবদ ৫৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা পরিশোধের খবর পাওয়া যায়।
সংবাদমাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশিত, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্ল্যান্ট-ফ্যাক্টর ৮০ শতাংশের ওপরে হলেও কোনো কোনো রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বছরে তার সক্ষমতার মাত্র ১২ বা ১৬ শতাংশ উৎপাদনে ছিলো। এরপরও এসব কেন্দ্র উৎপাদন না করে অচল বসে থেকেই বছরে শত শত কোটি টাকা আয় করে নেয়। সরকার চাইলেই তার তালিকা করতে পারে। দেখতে পারে এ খাতে কতো ধরনের অনাচার হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিনিয়োগের সময় সরকারের সাথে চুক্তি করে বিদ্যুৎ না নিলে যে লোকসান হবে তার একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ সরকারকে পেনাল্টি দিতে হবে। সেই হিসেব করে সরকারও এ চুক্তি করে বসে। আর সেটা করতে করতে দেশে এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে ১৭০ ছাড়িয়ে যায়। এই কেন্দ্রগুলির অনেকটিতেই এখন প্রাথমিক জ্বালানির অভাবসহ চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্র সচল হয়, অচলও হয়। সব মিলিয়ে দেশে সব কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। ক্যাপটিভ এবং নবায়নযোগ্য দিয়ে মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। এরমধ্যে একদিন সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। দেশে এ মুহূর্তে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট হলেও সরকারি নথিতে থাকা সেই ২৭ হাজারের সক্ষমতা কাজে আসছে না। বরং এখনকার উৎপাদন বাস্তবতা ১৩ আর ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কখনো কখনো ঘাটতি হচ্ছে ৩ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এর অর্থ কয়লা, গ্যাস বা তেলের অভাবে বা কিনতে না পারার কারণে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ এখন উৎপাদন হচ্ছে। এর ফলে দেশের মোট ৬ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটারের বিতরণ লাইন রাত-দিনের একটা বড় সময় বিদ্যুৎ সঞ্চালন না করেই মাথার ওপর ঝুলে আছে।
অবশ্য পায়রার দেশীয় অংশের প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, অবশেষে এলসি খোলা হয়েছে। এ মাসের ২০ তারিখের পর কয়লা এসে পৌঁছুবে। এবং তারপর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে পায়রার। এই ভবিষদ্বানীর বাস্তবায়ন হবার আগে অক্ষম ডানার কারণে উড়তে না পারা পায়রার মাশুল ঠিক কত হবে তার জন্যও এ মাসের শেষের তারিখগুলোর দিকে খেয়াল থাকবে অনেকের।
দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে পড়াশুনায় মন বসাতে না পারা শিক্ষার্থীরাও কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অপেক্ষায়। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার উত্তম প্রস্তুতিও এই বিদ্যুতের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। বিদ্যুৎ না থাকলে তাদের প্রস্তুতিও ব্যাহত হবে। ইতোমধ্যে অতিরিক্ত গরমে চার দিন স্কুল বন্ধ থাকার ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে, বিদ্যুৎ না থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কি গতি হয়।
লেখক : বোরহানুল হক সম্রাট, প্ল্যানিং এডিটর, দৈনিক আমাদের বার্তা