টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিনে গিয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন শিক্ষকদের একটি সিন্ডিকেটের কথা উঠে এসেছে। পাওয়া গেছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হলো দুই পক্ষই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এখানে ব্যবহার করেছেন।
এ বিষয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে শিক্ষার্থীদের দুটো অভিযোগ পত্র এসেছে। একটি অভিযোগ পত্রে প্রধান শিক্ষক কানিজ সালমার বিরুদ্ধে ও সহকারী শিক্ষক হাসমত আলীর পক্ষে গুণগান করে লেখা। অন্যটিতে সহকারী শিক্ষক হাসমত আলীর বিরুদ্ধে ও কানিজ সালমাকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরে লেখা।
জানা যায়, ‘কোটি টাকা দুর্নীতি করেও বহাল তবিয়তে প্রধান শিক্ষক’ শিরোনামে ১০টি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উল্লেখ করে একটি অভিযোগ পত্র ২৫টি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাসমত আলীর বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কানিজ সালমা অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন জেলা প্রশাসন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে।
জানা গেছে, গত ৬ মে বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক শরিফুল ইসলাম এবং শামছুল হকের সহযোগিতায় হাসমত আলী বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কাজে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করায় প্রধান শিক্ষক কানিজ সালমা তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করেন। পরে গত ১২ মে জেলা প্রশাসক বরাবর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাসমত আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কানিজ সালমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হাসমত আলী বলেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের লিখিত অনুমতি ছাড়া, কারো সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই শিক্ষকদের নামাজের কক্ষ ভেঙে কর্মচারীদের কক্ষ সম্প্রসারণ করেছেন। তিনি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিকক্ষদের জন্য কোনো নামাজের কক্ষের ব্যবস্থা রাখেননি বিদ্যালয়ে যোগদানের তৃতীয় কর্মদিবসে ১১ জুন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবগুলো তার নিজের নামে চালু করেই বিবিধ তহবিল হিসাব থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং টিফিন তহবিল হিসাব থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা মোট ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিজ নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
এ ছাড়া কম্পিউটার তহবিল থেকে গত ২৩ জুলাই ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৯৩ হাজার ৫০ টাকার কম্পিউটার সামগ্রি কিনে ৭ লাখ ৮১ হাজার ৪২৬ টাকার ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। বিজ্ঞানাগারের জন্য বড় টেবিল ক্রয় বাবদ ৭৮ হাজার টাকার ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি আরো জানান, প্রতিটি বিল ভাউচারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর নেই।
অভিযোগ অস্বীকার করে কানিজ সালমা বলেন, এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসার ব্যাপারে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাসমত আলী তথ্য দিয়ে, বিভিন্নভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সেজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখানে এসে আমি রীতিমতো হতবাক হয়ে যাই। হাসমত আলীসহ আরো চারজন শিক্ষকের একটি সিন্ডিকেট দেখতে পাই। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে থাকেন হাসমত আলী। আমার রুমে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। বিশেষ করে হাসমত আলী।
আমি এই বিদ্যালয়ে যোগদানের দিন কয়েকের মধ্যেই সবগুলো ব্যাংকের চেক বই জোরপূর্বক আমার থেকে নিয়ে নেন হাসমত আলী। এরপর একের পর এক রিকুইজিশন জমা দেন আর আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নেন।
তিনি বলেন, হাসমত আলীর বিরুদ্ধে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাবা-মা ও পরিবারের শিক্ষার দিকে আঙুল তুলে কথা বলেন। প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় শিক্ষাথীদের ফেল করিয়ে দেয়ার হুমকি দেন, শিক্ষাথীদের কাছে দামী উপহার চেয়ে নেন। এসব বিষয়ে শিক্ষাথীরা অভিযোগ করেছেন।
কানিজ সালমা আরো বলেন, ২৫টি দপ্তরে অভিযোগ পত্র পাঠিয়েছেন সহকারী শিক্ষক হাসমত আলী। অভিযোগ পত্রে অভিভাবক মাসুদুল আলম নাম থাকলেও মূলত তিনিই অভিযোগকারী। জেলা প্রশাসনের তদন্তে এ নামে কোনো অভিযোগকারীকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী শিক্ষক হাসমত আলী বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেন। বিদ্যালয়ের বাইরে তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে জানান, অভিযোগকারী তিনি। কিন্তু বিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষকদের সামনে তিনি বলেন, এই অভিযোগকারী দেলদুয়ার উপজেলার সৈয়দ আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মাসুদুল আলম।
কেনো ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এই বিদ্যালয়ের বিষয়ে অভিযোগ করবেন জানতে চাইলে হাসমত আলী বলেন, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসার আগে কানিজ সালমা দেলদুয়ার উপজেলার সৈয়দ আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মাসুদুল আলম ছিলেন সিনিয়র শিক্ষক। সেখান থেকেই তাদের মধ্যে শত্রুতা। এ বিষয়ে কানিজ সালমা এবং মাসুদুল আলম পূর্ব শত্রুতার কথা অস্বীকার করেন।
কানিজ সালমা বলেন, সহকারী শিক্ষক হাসমত আলীর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর শিক্ষার্থীদের অভিযোগ করার কথা জানতে পেরে জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় বিদ্যালয়ের সব শিক্ষকদের সামনে হাসমত আলী তার অপরাধের কথা স্বীকারও করেন। একটা সময় আমি যখন তার এই ধরনের কার্যকলাপের প্রতিবাদ শুরু করি তখনই তিনি বিদ্যালয়ের গোপন কাগজপত্র মিডিয়ার কাছে দেয় এবং ২৫টি দপ্তরে বেনামে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র জমা দেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাসমত আলী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমি প্রধান শিক্ষক কানিজ সালমাকে এখানে এনেছি তাই আমার আধিপত্য তো থাকবেই। বিদ্যালয়ের চেক বই কেনো তার কাছে রেখেছিলেন জানতে চাইলে হাসমত আলী বলেন, প্রধান শিক্ষক রাখতে বলেছেন তাই রেখেছিলাম।
এসব বিষয়ে বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, আমরাও শুনেছি প্রধান শিক্ষক কানিজ সালমাকে এই বিদ্যালয়ে এনেছেন সহকারী শিক্ষক হাসমত আলী। প্রধান শিক্ষক এখানে যোগদান করার পর প্রায় আট মাস আমরা কেউই তার দপ্তরে যেতে পারিনি।
এদিকে অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একের পর এক তদন্ত চলছে। প্রধান শিক্ষক কানিজ সালমা এবং সহকারী শিক্ষক হাসমত আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লিখিত এবং মৌখিক জিজ্ঞাসায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।