বিশ্বতত্ত্ববিদ ড. জামাল নজরুল ইসলাম জন্মদিন আজ - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্বতত্ত্ববিদ ড. জামাল নজরুল ইসলাম জন্মদিন আজ

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, ও বিশ্বতত্ত্ববিদ জামাল নজরুল ইসলাম এর জন্মদিন আজ। তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্য আল্টিমেট ফেট অব দি ইউনিভার্স’ তার একটি বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ।

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এইদিনে ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তখন সে শহরের মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য) ছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র এক বছর তখনই তার বাবা কলকাতায় বদলি হন। জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীকালে শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়েন। পরবর্তীতে আবার মডেল স্কুলে ফিরে যান। কলকাতায় মডেল স্কুলের পর চট্টগ্রামে চলে আসেন। এখানে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেন। এই ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে ‘ডাবল প্রমোশন’ দিয়ে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি নেয়া হয়। নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। অনেক অতিরিক্ত জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। নবম শ্রেণিতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। এ সময় নিজে নিজে অনেক অঙ্ক করতেন। বিভিন্ন বই থেকে সমস্যা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন যা পরে তার অনেক কাজে আসে।

উল্লেখ্য, হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই কেবল গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই তিনি গণিতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান। এখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন।

এই কলেজের একজন শিক্ষককে তিনি নিজের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই শিক্ষকের নাম ‘ফাদার গোরে’। গণিতের জটিল বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন বলেই জে এন ইসলাম তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। গোরে তার কাছে গণিতের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন, ইসলাম আগ্রহভরে তা শেয়ার করতেন।

বিএসসি শেষে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এখান থেকেই ১৯৬০-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে এসসিডি (ডক্টর অব সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জামাল নজরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইসলাম কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এখানে তিনি আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতেন এবং এই সূত্রে স্টিভেন হকিংয়ের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে৷

১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলেন এবং এখানকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুই হাজার আটশো টাকা বেতনে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানেই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। এক বছর অধ্যাপনা করার পরে পুনরায় বিদেশে যেতে চাইলে কিছুতেই বিশ্ববিদ্যালয় সিণ্ডিকেট থেকে ছুটি পাননি তিনি। ফলে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশযাত্রা করেন জামাল নজরুল ইসলাম এবং পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব স্থায়ী বাড়ি-ঘর, জমি-জায়গা বিক্রি করে দিয়ে পাকাপাকিভাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে পুনরায় কাজে বহাল করে এবং বেতন বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করে। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক কোটা খালি না থাকায় তিনি গণিত বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা রিসার্স সেন্টার ফর ম্যাথম্যাটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস)। এখানেই তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন।

জামাল নজরুল ইসলাম বই পড়তে ভালোবাসতেন। তবে তিনি শখ হিসেবে গান শোনা ও ছবি আঁকার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রসংগীত ছিলো তার সবচেয়ে প্রিয়। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এর প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারে তার অনীহা ছিলো। গাণিতিক হিসাব মাথা খাটিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তাই কম্পিউটারের ব্যবহারও তার কাছে ভালো লাগতো না। এই অপছন্দের মূল কারণ অবশ্য অপ্রয়োজনীয়তা। তিনি বলতেন, ‘ক্যালকুলেটর মস্তিষ্ককে অলস করে দেয়।’ তার ধারণা ছিলো, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম দিন দিন অতিরিক্ত টেলিভিশন ও মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ায় তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে।

তার চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিলো দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে অসচ্ছল ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এই পরোক্ষ অবদান ও পরবর্তীকালে দেশে ফিরে আসা থেকে তার দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেন।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে একটি গুজব রটেছিলো। বাংলাদেশেও এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে দেখান যে, সে রকম সম্ভাবনা নেই। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হবে না।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তাকে কাজী মাহবুবুল্লাহ অ্যান্ড জেবুন্নেছা পদক প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত করে। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ‘রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক’ প্রদান করে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ মেয়াদের জন্য তাকে ইউজিসি অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

অধ্যাপক ইসলাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল অ্যান্ড ফিজিকাল সায়েন্সের গবেষক এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-র উপদেষ্ঠা-পর্ষদের সদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘উচ্চতর গবেষণা সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন (বাছাই) কমিটি’র চেয়ারম্যান ছিলেন।

বিখ্যাত এই বিজ্ঞানী ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে গরিবুল্লাহ শাহ মাজার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার - dainik shiksha কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত - dainik shiksha উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে - dainik shiksha ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - dainik shiksha সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের - dainik shiksha জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক - dainik shiksha মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030860900878906