দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশে। অনুমোদিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে শতাধিক। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যদিও সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হয়নি। স্বল্প পরিসরে হলেও কৃষি, প্রকৌশল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কতজন শিক্ষকের গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে? পরিসংখ্যানে দেখা যায়, একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সেই গবেষণা হতে হবে সময়োপযোগী এবং চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান উচ্চশিক্ষায় বিশ্বমানের গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে যাচ্ছে। ওই ডিগ্রিগুলোতে কোর্সের পাশাপাশি গবেষণার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ছাড়াও মাস্টার্স ডিগ্রি দিয়ে থাকে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েট ক্যাটালগ অনুসরণ করে থাকে। ওই ক্যাটালগে প্রতিটি ডিগ্রির কোর্স কারিকুলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ডিগ্রি প্রদানের আগে গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশনার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। যদি গবেষণালব্ধ ফলাফল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশনায় ব্যর্থ হয়, তাহলে ডিগ্রি প্রদানের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি প্রদানের আগে প্রকাশনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়। অন্যদিকে আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থিসিসে প্রকাশযোগ্য আর্টিক্যালও বিবেচনায় নিয়ে ডিগ্রি প্রদান করে থাকে। প্রতিটি প্রকাশনায় লেখকের নাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও ঠিকানা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মানসম্মত গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এভাবে গবেষণার মাধ্যমে গবেষকরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে থাকেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব গবেষণা দপ্তর রয়েছে। এ গবেষণা দপ্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সহয়তায় শিক্ষকদের গবেষণার জন্য প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। যদিও ওই গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কম, তবু গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা এ প্রকল্পের আওতায় ডিগ্রি সম্পন্ন করে থাকে। বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলসহ বহু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য প্রকল্পের অধীনে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। যদি যাচাই-বাছাইজনিত ত্রুটি থাকে, তাহলে মানসম্মত প্রকল্পগুলো বাদ পড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ সমস্যা দূরীকরণে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় নেওয়া উচিত। নতুবা বাংলাদেশ মানসম্মত গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশে ব্যর্থ হতে পারে।
গবেষণালব্ধ ফলাফল থিসিসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জার্নালেও প্রকাশিত হয়ে থাকে। আর্টিক্যালটি জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার আগে পিয়ার রিভিউতে পাঠানো হয়। অনেক সময় জার্নালের স্কোপ ও নোবিলিটির অভাবে আর্টিক্যালটি সম্পাদক রিভিউতে পাঠানোর পরিবর্তে বাতিল করে দিতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নেচার, সায়েন্স, দ্য ল্যানসেট ও সেলসহ শতাধিক মানসম্মত একাডেমিক জার্নাল রয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত গবেষণার আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে স্প্রিঞ্জার, এলসিভিয়ার, এমডিপিআই ও হিন্ডাওইও মানসম্মত একাডেমিক আর্টিক্যাল প্রকাশ করে যাচ্ছে। ওইসব জার্নালে বাংলাদেশের বহু বিজ্ঞানীও নিয়মিত তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করে যাচ্ছেন। যদিও সংখ্যার হিসাবে কম, তবুও গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেক বিজ্ঞানীর নাম দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এভাবে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের তালিকায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের নাম যুক্ত হওয়ার বিষয়টি মর্যাদাপূর্ণ।
অনেক জার্নালে প্রকাশিত আর্টিক্যালে প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ থাকে। যেসব আর্টিক্যালে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত থাকে, সেসব আর্টিক্যালের শুধু অ্যাবস্ট্রাক্টটি পড়া যায়। যদিও উভয় আর্টিক্যালই গবেষক কর্তৃক প্রকাশিত অন্য আর্টিক্যালের সাইটেশন হতে পারে। তবে যেসব আর্টিক্যাল গবেষকরা সহজেই পড়তে পারেন, সেসব আর্টিক্যালের সাইটেশন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কোনো বিজ্ঞানীর প্রকাশিত আর্টিক্যালের সাইটেশন বেশি হয়, তাহলে সেই আর্টিক্যালের মাধ্যমে ওই বিজ্ঞানী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে পারেন। গুগল স্কলার, ওয়েভ অব সায়েন্স, পাবমেড, স্কোপাস ও এসসিআইসহ বহু ইনডেক্সিং সাইট রয়েছে। এসব ইনডেক্সিং সাইটের সঙ্গে অনেক জার্নালের সরাসরি লিঙ্ক রয়েছে। জার্নালগুলোর গুণমান নির্ভর করে ইনডেক্সিংয়ের ওপর। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, ইনডেক্সিং জার্নালে প্রকাশিত গবেষণালব্ধ ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা অন্যান্য জার্নালের প্রকাশনার তুলনায় বেশি।
জার্নালগুলোর ইমপেক্ট ফ্যাক্টরও গবেষণার গুণমান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। একটি জার্নালের ২ বছরে মোট অর্জিত সাইটেশনকে মোট প্রকাশিত আর্টিক্যাল দ্বারা ভাগ করে ইমফ্যাক্ট ফ্যাক্টর ক্যালকুলেশন করা হয়ে থাকে। ওই ইমপেক্ট ফ্যাক্টর সাধারণত ক্লারিভেট ওয়েভ অব সায়েন্স দ্বারা ক্যালকুলেশন করা হয়ে থাকে। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর আছে এমন জার্নালে যদি আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়, সেটি নিঃসন্দেহে গবেষকদের জন্য খুবই মর্যাদাপূর্ণ। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, গবেষণার গুণমান বৃদ্ধিতে জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
যাই হোক, ওই ইনডেক্স দ্বারা একজন গবেষক প্রকাশিত আর্টিক্যালের গুণমানের ভিত্তিতে গবেষণায় নিজের অবস্থান নির্ণয়ে সক্ষম হন। ইনডেক্স অনুযায়ী একজন ব্যক্তির যদি এইচ ইনডেক্স ৫ হয়, তাহলে তিনি সহকারী অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। যদি এইচ ইনডেক্স ৮ থেকে ১২ হয়, তাহলে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৫ থেকে ২০ হলে অধ্যাপকের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। ওই যোগ্যতা শিক্ষকদের সমগ্র বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দিতে কখনো কার্পণ্য করে না। অন্যদিকে আইটেন (i10) ইনডেক্সও গবেষকদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে থাকে। যদি কোনো প্রকাশিত আর্টিক্যালের সাইটেশন ১০ হয়, তাহলে সেটির আইটেন ইনডেক্স ১ ধরা হয়। যদি কোনো গবেষকের মোট প্রকাশিত ৫০টি আর্টিক্যালের মধ্যে ৩০টির সাইটেশন ১০ হয়, তাহলে সেই গবেষকের আইটেন ইনডেক্স হবে ৩০। মোটা দাগে বলা যায়, এইচ ও আইটেন ইনডেক্স গবেষকদের গবেষণার গুণমান সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।
বর্তমানে বিশ্বে কোলাবোরেটিভ গবেষণারও গুরুত্ব অপরিসীম। গবেষকদের কোলাবোরেশন নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকাশিত আর্টিক্যালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, এইচ ও আইটেন ইনডেক্সের ওপর। যদি মানসম্মত গবেষণা প্রকাশিত হয়, তাহলে বিশ্বের র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক/গবেষকরা একে অপরের সঙ্গে কোলাবোরেশনে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন। ওই কোলাবোরেশন তাদের সুনাম অর্জনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিটি দেশের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। ওই সমস্যাগুলোর আলোকে গবেষণার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়। আবার ওই ক্ষেত্রের আওতায় বহু থিমেটিক ক্ষেত্র যোগ করা হয়।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে। উন্নত দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার প্রাধান্য রয়েছে। সেসব দেশে গবেষকরা কখনো নিজেদের অবদান ছাড়া প্রকাশিত আর্টিক্যালে কো-অথর হিসাবে থাকতে সম্মত হন না। কিন্তু বাংলাদেশের বহু গবেষক ও শিক্ষক গবেষণায় কোনোরকম অবদান না রেখেই অন্যের প্রকাশনায় নিজের নাম যোগ করে থাকেন। সেক্ষেত্রে নাম দেওয়া ও নেওয়া দুটিই অনৈতিক। এসব অনৈতিক বিষয় থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। নতুবা নৈতিকতার অবক্ষয়ের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের প্রকাশনার ক্ষেত্রে অবশ্যই নৈতিকতার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। নতুবা পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষকদের কাছ থেকে কী শিখবে?
গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান দ্বারা নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হতে পারে। সেই প্রযুক্তি শিল্পায়নে ব্যবহার হতে পারে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক সুনাম বৃদ্ধি সম্ভব। গবেষণা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ভূমিকা রাখায় সামাজিক জীবনের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় উৎপাদিত নতুন প্রযুক্তি মানবজাতির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদিত প্রযুক্তি মানবসম্পদ বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে থাকে। ওই উৎপাদিত প্রযুক্তি সম্প্রসারণে জ্ঞানের বিকাশও বৃদ্ধি পায়। আবার সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তা সম্প্রসারণেও ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণা জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, মানবসম্পদ বৃদ্ধি, জ্ঞানের সম্প্রসারণ, উদ্ভাবনী ক্ষমতার বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষার আবরণে আবৃত শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে দেশের উন্নয়ন সম্ভব। গবেষণার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
লেখক : ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর