দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি, ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালানো, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে লিঙ্গবৈষম্য ও যৌন সহিংসতা বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। একইসঙ্গে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে টোলফ্রি হটলাইন নম্বর ও অনলাইনে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা চালুর কথাও বলেন তারা।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল রোববার বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত ‘যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা: বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।
বাকস্বাধীনতা বিশেষজ্ঞ ও ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তাহমিনা রহমান যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বিষয়ক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন। তিনি সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া যৌন সহিংসতার ঘটনাসমূহ নিয়ে কথা বলেন। একই সঙ্গে, যৌন সহিংসতার ঘটনা প্রতিরোধে দেশে বিদ্যমান আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং একই সঙ্গে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) নিয়েও কথা বলেন।
বক্তব্যে তাহমিনা রহমান সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা, যৌন হয়রানি নিরসনে সুনির্দিষ্ট একটি আইন এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন দ্রুত প্রণয়ন করা, যৌন সহিংসতা বিষয়ক অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্যে যখন সিন্ডিকেট সভায় পাঠানো হয়- সেই পর্যায়ে ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা; বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করা, তদন্ত ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করা; প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে টোলফ্রি হটলাইন নম্বর ও অনলাইনে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা চালু করা এবং সর্বোপরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতি জোর দেন।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ব্লাস্টের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সদস্য এবং জ্যেষ্ঠ্য আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বলেন, দলনিরপেক্ষ স্বজন প্রীতির উর্ধ্বে গিয়ে যৌন হয়রনির বিষয়ে মোকাবিলা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত নিয়োগের দৌরাত্ম্য হ্রাস করতে হবে। সেই সঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ন্যায়বিচারের স্বার্থে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও নির্দেশনা বিষয়ে সচেতনতার অভাব, কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা ও মনিটরিংয়ের অভাব, অভিযোগ দায়ের ক্ষেত্রে অভিযোগ বক্সের পাশাপাশি অনলাইনে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা করা, ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্ত উভয়েরই পরিচয় প্রকাশে গোপনীয়তা অবলম্বন করা, মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের প্রমান পাওয়া গেলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তি গ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড লিগ্যাল স্টাডিজের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের ১১ দফা সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও দেশে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, যৌন সহিংসতায় ভুক্তভোগী নারীর সম্মানহানির ভয়, যৌন সহিংসতায় ভুক্তভোগী নারীকে সমাজে গ্রহণযোগ্যতার মানসিকতা তৈরি না হওয়া, বিচারহীনতার কারণে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে সম্পূর্ণ নতুন আইন প্রণয়ন না করে, সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। একইসঙ্গে তিনি যৌন সহিংসতা বিষয়ক অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত অনুমোদনকালে সিন্ডিকেট সভায় ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধে নির্বাচনের সময়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকারনামায় যৌন হয়রানি নিরসনের বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্তিকরণের দাবি জানান।
প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আইনুনাহার সিদ্দিকা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের ১১ দফা সুস্পষ্ট নির্দেশনা সংবলিত যুগান্তকারী এ রায়টি প্রদানের ১৫ বছর পার হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। মূল কারণ হচ্ছে এ নির্দেশনা বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার অপ্রতুলতা, সংশ্লিষ্ট জবাবদিহিতা ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট রায় থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এ বিষয় মানার বাধ্যবাধকতা নেই, যা আদালতের রায়ের অবমাননার সামিল। বিচার পেতে দেরি হওয়ার কারণ দেখতে গেলে সিন্ডিকেটের বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মূল কারণ হিসেবে দেখা যায়। আইনগত দিক থেকে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের সঞ্চালনায় এ মতবিনিময় সভায় ব্লাস্টের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য এবং উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (আইন) অ্যাডভোকেট মো. বরকত আলী।