জ্ঞান ও বিকাশের প্রতীক হিসেবে পরিচিত এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সহিংসতা ও ভয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম তিন সপ্তাহেই একাধিক হত্যাকাণ্ড দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের বাধ্য করেছে একটি অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে। এই নৃশংস ঘটনার পেছনে আসলে কাদের হাত আছে ও এবং কীভাবে আমাদের ক্যাম্পাসগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হলো। যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার দাবি করছে, তাদের মাঝেই এই হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রকৃত রহস্য ধোঁয়াটে রয়ে গেছে। এই সহিংসতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং এটি একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতার অংশ, যা সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনা এই ভয়াবহ প্রবণতাটি কীভাবে অগ্রসর হচ্ছে তার একটি ভীতিকর চিত্র তুলে ধরছে।
ঘটনা-১: গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চুরির সন্দেহে এক ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে মারধর করে একদল শিক্ষার্থী। তাকে মারার আগে ক্যানটিনে নিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। পরবর্তীতে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। একটা প্রশ্ন করা যাক। বলুন তো কেনো সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধীরও মানবাধিকার প্রাপ্য? উত্তরটি সহজ, যাতে আমরা নিজেরাই অপরাধী হয়ে না যাই। কেউ চোর হলেও আমাদের দায়িত্ব হলো আইনসংগতভাবে তাকে নিরস্ত্র করা। তাকে হত্যা করা বা নির্যাতন করা নয়। কিন্তু ঢাবির শিক্ষার্থীরা ন্যায়বিচার নিজের হাতে তুলে নেয়ার সাহস কোথা থেকে পায়?
ঘটনা-২: একই দিনে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেয়া হয়। সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার রাতেই তার মৃত্যু হয়।
ঘটনা-৩: এর আগে এই মাসে, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সামনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদের ওপর আক্রমণ করে ছাত্র-জনতা। ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এই নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সহিংসতার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ঘটনাগুলো আবরার হত্যার স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা ‘গেস্টরুম কালচারের’ নাম করে তাকে হত্যা করে। সেই ঘটনাটি জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে, যার ফলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ সত্ত্বেও সহিংসতার এই সংস্কৃতি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো রয়ে গেছে এবং আরো বাড়ছে।
এক রাতেই দেশের শীর্ষ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা এই ঘটনাগুলোর জন্য দায়ীদের সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। কারণ, তারা সহিংসতা ও শোষণের শিকার হতে চায় না। কিন্তু এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের তৎপরতা নেই, তাহলে এই হত্যাকাণ্ডগুলো কারা ঘটাচ্ছে?
সম্প্রতি, ঢাবির কার্জন হলে এক দম্পতিকে আটক করা হয়, যেখানে দেখা যায় ছেলেটি ভুয়া ঢাবির আইডি কার্ড ব্যবহার করছে। শিক্ষার্থীরা যখন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন, তখন প্রক্টরিয়াল টিমের দায়িত্ব থাকে তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করা। তবে ফেসবুকের একটি পোস্ট থেকে জানা যায়, প্রক্টর নাকি শিক্ষার্থীদের এই পরিস্থিতি সামলাতে পাঠিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, প্রক্টর কি শিক্ষার্থীদের এ ধরনের দায়িত্ব পালন করতে পাঠাতে পারেন? যখন যোগাযোগ করা হয়, তিনি শিক্ষার্থী পাঠানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে উল্লেখ করেন, অন্য একজন কর্মকর্তা হয়তো পাঠিয়ে থাকতে পারেন। পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোতে, যেমন টিএসসিতে চায়ের দোকান ভাঙচুর বা উচ্ছেদের সময়ও শিক্ষার্থীরা প্রক্টরিয়াল টিমের সঙ্গে ছিলেন।
আমার প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা এসব কাজে কেনো যুক্ত হচ্ছেন? এগুলো কি শিক্ষার্থীদের কাজ? এই সম্পৃক্ততা কি শিক্ষার্থীদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত প্রবেশের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। কিন্তু পূর্বে এই সমস্যাটি এভাবে সহিংসতার দিকে যায়নি। এখন কেনো এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে? উত্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা। শিক্ষার্থীরা দায়ী নন, এর দায় প্রশাসনের। এই প্রশাসনই, যখন ঢাবি শিক্ষার্থীরা মেট্রোরেলের বিরোধিতা করেছিলো, তখন নীরব ছিলো। আর এখন, মেট্রোরেল, যানজট এবং ঢাকায় পাবলিক স্পেসের অভাবে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে ভিড় বাড়ছে, এবং প্রশাসন এই সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে।
কিন্তু এর খেসারত কে দিচ্ছে? এই দায়িত্বের অপরিকল্পিত স্থানান্তর ঢাবি শিক্ষার্থীদের ভাবমূর্তিকে কলুষিত করছে। এর ফলে ঢাকার মানুষ এখন ঢাবি শিক্ষার্থীদের শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেছে এবং ইতিমধ্যে তাদের নিয়ে হাসাহাসিও শুরু হয়ে গেছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে রয়েছে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এক শিক্ষার্থীর ভাষায়, ‘আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে কাউকে থাপ্পড় মারার আগেও দুইবার ভাববো।’ এই বক্তব্যটি এমন একটি সাধারণ মতামত প্রতিফলিত করে যা অনেক শিক্ষার্থী মনে করে-বাইরের চাপ বা প্ররোচনা ছাড়া তাদের সহপাঠীরা এমন নৃশংস ঘটনা ঘটাতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অত্যন্ত বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের অনেক জনপ্রিয় দাবির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করছে, কিন্তু তাদের এনফোর্সারের ভূমিকা পালন করার ক্ষমতা কে দিচ্ছে? উত্তর স্পষ্ট, প্রক্টর। জাতির কাছে প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতোদিন ধরে লুকানো রাজনৈতিক স্বার্থের যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে থাকবে? আর কতোজনকে জীবন দিতে হবে এই সহিংসতার চক্র বন্ধ করার আগে?
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়