দেশের বেসরকারি মেডিক্যালে কলেজে এমবিবিএস ও বিডিএস প্রথমবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে বিতর্ক চলছে। এত দিন কলেজগুলো নিজেদের মতো করে শিক্ষার্থী ভর্তি করত। শিক্ষার্থীরা পছন্দের কলেজে আবেদন করতেন। সেখান থেকে মেধা ক্রমানুসারে ভর্তি হতে পারতেন তারা। কিন্তু এবার সরকার অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি করে দিয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা অনলাইনে কলেজ পছন্দ করবেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সে অনুযায়ী কলেজের আসনসংখ্যা ও মেধাক্রমে ভর্তিযোগ্য কলেজ নির্দিষ্ট করে শিক্ষার্থীকে খুদে বার্তা পাঠাবে। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভর্তি করবে।
এই অটোমেশন পদ্ধতি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পেশাজীবী দুটি সংগঠন। একপক্ষ বলছে, অটোমেশন পদ্ধতি ‘ভালো’। এতে এত দিন ধরে চলে আসা বেসরকারি মেডিক্যালে কলেজে ভর্তি নিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও ভর্তি-বাণিজ্য বন্ধ হবে। মেধার সমবণ্টন হবে। সব কলেজ শিক্ষার্থী পাবে। অন্যপক্ষ এই ব্যবস্থাকে ‘হ-য-ব-র-ল’ বলছে। তাদের মতে, পছন্দমতো কলেজে ভর্তি হতে না পেরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিকিৎসা শিক্ষায় অনীহা তৈরি হতে পারে। ধনীর ছেলেমেয়েদের পড়তে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দেবে। অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে পরিচালনা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হবে কলেজ কর্তৃপক্ষকে। এই খাতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে ভাটা পড়তে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
এমন তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই ভর্তির সব প্রক্রিয়া শেষ করে এনেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। ইতিমধ্যেই কলেজ নির্দিষ্ট করে শিক্ষার্থীদের কাছে ভর্তি হওয়ার খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। আজ থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ভর্তি চলবে।
এ বছর দেশের ৭১টি বেসরকারি মেডিক্যালে কলেজে দেশি-বিদেশি মিলে ৬ হাজার ৭৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবেন। গত ৬ এপ্রিলের মধ্যেই সরকারি ৩৭টি মেডিক্যালে কলেজে ৪ হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। এ বছর বেসরকারি মেডিক্যালে কলেজে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের এককালীন ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা গুনতে হবে, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ বলেন, পদ্ধতিটি নতুন হওয়ায় অনেকের কাছে জটিল মনে হচ্ছে। মেডিক্যালে কলেজের কোনো গ্রেডিং করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের পছন্দের মধ্যেই তার মেধাক্রম অনুযায়ী কলেজ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এতে সব কলেজে শিক্ষার্থী সমবণ্টন হবে।
নিজ পছন্দে না, মেধার ক্রমানুসারে ভর্তি : বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যালে কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) অটোমেশন পদ্ধতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই সংগঠনের মতে, সরকারের ২০২৩ সালের ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী, একটি আসনের বিপরীতে পাঁচজন শিক্ষার্থীর আবেদন করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতি আসনের জন্য একজন করে আবেদন করেছেন।
বিষয়টিতে উদ্বেগ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছে সংগঠনটি। সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, এবার বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তিতে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিপিএমসিএর নির্বাহী পরিচালক মতিউর রহমান বলেন, এতে শিক্ষার্থীদের পছন্দ থাকছে না। মেধাক্রম ও কলেজের সিরিয়াল অনুযায়ী একজন প্রার্থীকে একটি নির্দিষ্ট কলেজে ভর্তি হতে বলা হচ্ছে। কিন্তু সেই তালিকা অনুযায়ী কলেজে শিক্ষার্থীরা যাচ্ছেন না।
গাজীপুরের তায়রুননেছা মেমোরিয়াল মেডিক্যালে কলেজের একজন কর্মকর্তা বিপিএমসিএকে জানিয়েছেন, এক অভিভাবকের দুই ছেলে বেসরকারি মেডিক্যালে কলেজে টিকেছে। তাদের প্রথম পছন্দ এই কলেজ। কিন্তু এক ছেলেকে এই কলেজে পাঠানো হয়েছে, আরেকজনকে পাঠিয়েছেন খুলনায়। এই অভিভাবক খুব বিপদে পড়েছেন। দুই ছেলেকে দুই জায়গায় রেখে পড়ানোর মতো আর্থিক সংকুলান হচ্ছে না।
বিপিএমসিএর এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আগে কলেজে জমা হওয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ মেধা তালিকা করত ও মেধাক্রম অনুযায়ী ভর্তি করত। তার পরও দেখা যেত, ৩০-৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী শুধু আর্থিক সংকটের কারণেই ভর্তি হতেন না। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সব টাকা সরকার দিচ্ছে। সার্ক কোটায় যেসব শিক্ষার্থী আসছেন, তাদেরও সরকার বৃত্তি দিচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ সম্পূর্ণ ব্যক্তি অর্থায়নে চলে। তার ওপর যদি অটোমেশনের কারণে শিক্ষার্থী না পায়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান টিকবে কী করে?
ভর্তি-বাণিজ্য ও দুর্নীতি কমার আশা : ভর্তির ক্ষেত্রে অটোমেশন পদ্ধতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে নামকরা কলেজগুলো। এ ব্যাপারে রাজধানীর বড় মগবাজারের ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. ওমর শরীফ ইবনে হাসান বলেন, ‘অটোমেশনে এখন আর কলেজগুলোতে দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। সরকার যদি একটা সিস্টেম করে, ভর্তিতে স্বজনপ্রীতি দুর্নীতি না হয়, তাহলে অটোমেশনই ভালো। আমাদেরও একটা চাপ থাকে, একে নেওয়ার, ওকে নেওয়ার। সৎভাবে ভর্তি করালেও বলা হয় অসৎভাবে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমরা ঝামেলামুক্ত হলাম।’
তিনি বলেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজেও তো শিক্ষার্থীরা বান্দরবান, কক্সবাজারসহ সারা দেশে যাচ্ছেন। পড়ালেখা করতে হলে তো যেতেই হবে। তবে এমনও কলেজ আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেগুলোর নাম কেউ জানেন না বা চেনেন না, সেখানে ছাত্ররা যেতে চাইবেন না বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। টাঙ্গাইলের কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কলেজে কোনো নেগেটিভ প্রভাব পড়বে না। কারণ আমরা যে পরিমাণ ফোন ও সাড়া পেয়েছি, তাতে আমার মনে হচ্ছে রেজাল্ট দিলে আমাদের সব সিট ভরে যাবে। শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য এই পদ্ধতি ভালো হবে।’
হ-য-ব-র-ল বলছে বিএমএ : বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এ রকম ভর্তি পদ্ধতি নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভর্তির নামে একটা হ-য-ব-র-ল পদ্ধতি খুলে রেখেছে। ভালো চিকিৎসক চায়, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলো-বাতাস বন্ধ করে রেখেছে।’ তিনি বলেন, কিছু কিছু মেডিক্যাল কলেজ আসন অনুপাতে ভর্তিতে নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি নেয়। সেই অন্যায় রোধ করার জন্য পুরো পদ্ধতি বদলানো যাবে না। পদ্ধতিতে সংস্কার আনতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির যোগ্য হলে তার পছন্দমতো কলেজে ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের ইচ্ছামতো কলেজ নির্বাচন করে দিতে পারে না।
গ্রেডিং নেই, গ্রেডিং আছে : বিপিএমসিএ দাবি করেছে, সরকার কলেজগুলোর একটা গ্রেডিং করেছে। সেটা কীভাবে করেছে বলে না। সেই গ্রেডিং অনুযায়ী শিক্ষার্থী বণ্টন করছে। যে কারণে শিক্ষার্থীদের পছন্দ আর গুরুত্ব পেল না। একেকজন একেক দিকে চলে গেলেন। এই গ্রেডিংয়ের কারণেই অনেক কলেজ একজন ছাত্রও পাচ্ছে না।
কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের কোনো গ্রেডিং নেই বলে জানান ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. ওমর শরীফ ইবনে হাসান। তিনি বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে কলেজ র্যাংকিংয়ের প্রয়োজন নেই। স্টুডেন্ট র্যাংকিং করবে। স্টুডেন্ট পছন্দ দেবে। তারা পছন্দ দিলে মেধা অনুযায়ী সেখানে ভর্তির সুযোগ পাবে।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ধরুন, একজন প্রথম পছন্দ দিয়েছে ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ। এখানে আসন ১০০টি। যত আবেদন পড়েছে, সেখান থেকে নম্বর অনুযায়ী প্রথম ১০০ জনকে নেওয়া হবে। ১০১ নম্বর জন বাদ পড়ে যাবে। সে চলে যাবে তার দ্বিতীয় পছন্দের কলেজে। আর যদি এখানে ৯৫ জনই ১ নম্বর পছন্দ দেয়, তাহলে ৯৫ জনই ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাবে। আবার দ্বিতীয় পছন্দেও যদি নম্বরে না হয়, তাহলে চলে যাবে তৃতীয় পছন্দের কলেজে। এভাবে কোনো না কোনো মেডিক্যাল কলেজে সে ভর্তির সুযোগ পাবেই।’