শিক্ষক ও কর্মচারীদের বায়োমেট্রিক হাজিরা নিশ্চিত করতে ফেনী জেলার ৫৫৯টি সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে কেনা হয় মেশিন। তিন বছর পার হওয়ার আগেই হাজিরা মেশিনগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অলস পড়ে থাকায় ইতোমধ্যে প্রায় সব মেশিন নষ্ট হয়েছে। ফলে জলে গেছে সরকারের বিপুল অর্থ। এ ছাড়া এসব মেশিন কেনা নিয়েও রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ।
শিক্ষা অফিস সূত্র বলেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন-সংস্কার (স্লি-প ফান্ড) তহবিল থেকে প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কিনতে বলা হয়েছিল। তবে মেশিন কেনা হলেও দীর্ঘ সময়ে চালু করা যায়নি অনেক মেশিন।
সরজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, তৎকালীন ৬ উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষক নেতাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে এসব মেশিন কেনা হয়। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের স্লিফ ফান্ড থেকে চেকের মাধ্যমে মেশিন কেনার টাকা কোম্পানিকে পরিশোধ করেন। প্রতিটি মেশিন ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা মূল্যে কেনা হয়। যদিও বাজারে এ মেশিনের দাম ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। নিয়ম রয়েছে, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজার যাচাই করে নিজেদের পছন্দমতো সাশ্রয়ী মূল্যে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কিনে বিদ্যালয়ে স্থাপন করবে। নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে মেশিন ক্রয়ের বাধ্যবাধকতা নেই। নির্দেশনা উপেক্ষা করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেনা এসব মেশিন কিছুসংখ্যক বিদ্যালয়ে চালু হলেও কিছুদিনের মধ্যে তা অকেজো হয়ে পড়ে। শিক্ষকদের ভাষ্য, শিক্ষা অফিস থেকে চাপ প্রয়োগ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের হাজিরা মেশিন কিনতে বলা হয়েছিল। তখন তারা বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন। শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশে নির্ধারিত কোম্পানি ও চক্রের কাছ থেকে মেশিন কেনায় বাজার যাচাইয়ের সুযোগ পাননি তারা।
ফেনী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির এক অংশের সভাপতি মো. ওয়াজি উল্যা জানান, প্রতিনিটি স্কুল তাদের স্লিফ-ফান্ডের টাকা দিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে হাজিরা মেশিন কিনেছেন। কিন্তু সংযোগ না থাকায় অনেক স্কুলে তা ব্যবহার করা হয়নি। মেশিনটি এখন নষ্ট। অনেক মেশিন সরবরাহ করেছেন সরকার দলীয় নেতারা।
সোনাগাজী বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাধান শিক্ষক মো. এমদাদুল হক বলেন, মেশিনটা লাগানোর সময় উপজেলা শিক্ষা অফিস নতুন করে আর খোঁজ খবর নেয়নি। এছাড়া আমরাও ব্যবহার করি না। পৌরসভার পূর্ব তুলাতলী কবি নজরুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহানারা বেগম ২০২৩ সালে অবসরে চলে যান। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোশাররফ হোসেন জানান ডিজিটাল হাজিরা মেশিন সিম সেট করে লাগানো হয়েছিল। তবে যেদিন লাগিয়েছিল প্রথম দিনই ব্যবহার হয়েছে আর হয়নি। সোনাগাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসাইন আহমদ বলেন, উপজেলার ১১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে এই স্কুল আলাদাভাবে হাজিরা মেশিন পায়নি। আমাদের ডিজিটাল লেবের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়ার কথা থাকলেও এখনো এই ধরনের কোনো সেবাই পাইনি। মনগাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা আক্তার জানান, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন শিক্ষা অফিসের সঙ্গে সরাসরি মনিটরিং করার কথা থাকলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আমাদের বলা হয়েছে একযোগে মেশিনগুলো চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো চালু হয়নি। আমরাও ব্যবহার করিনি।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়,বিদ্যালয়ে হাজিরা মেশিন দরজার পাশে লাগানো থাকলেও তা ঝুলে আছে। অনেক স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা মেশিনটি কালো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় রয়েছে। ২০১৯ সালে নামমাত্র লাগালেও অনেক মেশিনারিজও তাদের এখনো দেয়া হয়নি। পশ্চিম চরছান্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কামরুল ইসলাম জানান, ৩ বছর ধরে এভাবে লাগানো আছে। ডিজিটাল হাজিরা মেশিন সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই, শুধু এতটুকু জানি একটা ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কিনে অফিস কক্ষের প্রবেশদ্বারে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। এই পর্যন্ত মেশিনটি ব্যবহার হয়নি। ডিজিটাল হাজিরা মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নামও জানা নেই স্কুল প্রধানের।
ফেনী সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাজমা আক্তার বলেন, আমি যোগদানের আগে মেশিনগুলো কেনা হয়েছে। কারা সরবরাহ করেছে তা আমি জানি না। ফেনী সদর উপজেলার ১১৫টি স্কুলের হাজিরা মেশিন এখন নষ্ট পড়ে আছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ফেনী জেলার ৫৫৯টি স্কুলের হাজিরা মেশিন নষ্ট হয়ে রয়েছে। স্লিফ-ফান্ডের টাকা দিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে হাজিরা মেশিন কিনেছেন স্কুল প্রধানরা। সরকারি সিদ্ধান্ত মতে স্ফিপের কেনার নির্দেশনা দিয়েছিলাম। তারা কার কাছ থেকে কিনেছেন, তা তাদের ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি জানি না।