ভালো নেই জাতীয় বনের জাতীয় পশু! - দৈনিকশিক্ষা

ভালো নেই জাতীয় বনের জাতীয় পশু!

সাধন সরকার |

আজ ২৯ জুলাই। ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’। বছর যাচ্ছে আর সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমছে! পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন-জঙ্গল ধ্বংস ও মানুষের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক বন্যপ্রাণী আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আবার কোনো কোনো বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশ থেকে ঈগল, বনমহিষের মতো অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। শকুনও বিলুপ্তির পথে। এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ বা বাঘ নিয়ে। বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর ও আকর্ষণীয় প্রাণী হচ্ছে বাঘ। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের বাঘ মূলত ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ নামে খ্যাত। বাঘ কমে যাওয়ার পেছনে বাঘের খাদ্য ও আবাসস্থলের সংকট, পাচারকারী ও শিকারিদের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ মানুষের নানা অসচেতনামূলক কর্মকাণ্ডই দায়ী।

সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিভিন্ন জরিপ বলছে, গত ৪২ বছরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। সরকারের বন বিভাগের জরিপে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিলো ৪৪০টি। একই সংস্থার জরিপে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৬টি। বেসরকারি বিভিন্ন জরিপেও মোটামুটি একই রকম তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে যুক্তরাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত ‘সুন্দরবনের বাঘ সমীক্ষায়’ বলা হয়েছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২১টি। সর্বশেষ জরিপে বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। বিভিন্ন জরিপে যেভাবেই বলা হোক না কেনো এ কথা সত্য, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের চিত্র ইতিবাচক। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস ও বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজারের কিছু বেশি। বাঘের সংখ্যা বেড়েছে এমন দেশের মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, ভারত ও নেপাল। ‘গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভের’ (জিটিআই) তথ্য মতে, বিশ্বের মোট বাঘের প্রায় ৮৫ শতাংশের বেশি বিংশ শতাব্দী শুরুর পর হারিয়ে গেছে। 

বাংলাদেশের জাতীয় বন সুন্দরবন। বিশ্বে বাংলাদেশ ‘সুন্দরবনের দেশ’ হিসেবেও অধিক পরিচিত। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশের জাতীয় বনে জাতীয় পশু থাকে। সুন্দরবনের সৌন্দর্যের প্রতীক ও সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণী বাঘ কমতে থাকলে সুন্দরবন ভালো থাকবে এমনটি মনে করার কারণ নেই। সুন্দরবন ও বাঘ একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু সুন্দরবন ও এর আশেপাশের পরিবেশ এখন বদলে যাওয়া শুরু করেছে। ধীরে ধীরে বনের আশেপাশে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পকারখানা। বনের ভেতর দিয়ে এখন প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় নৌযান চলাচল করছে। ফলে বাঘের স্বাভাবিক জীবনাচরণে সমস্যা হচ্ছে। আগে এমন পরিবেশ ছিলো না। আবার বনে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য তো রয়েছেই। বাঘের আবাসস্থল নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। 

দেশে-বিদেশে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদা থাকায় বাঘ পাচারকারীরা সময়-সুযোগ বুঝে বাঘ হত্যা করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনে বাঘের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের  মতে, সুন্দরবনে প্রতিবছর কমপক্ষে চার-পাঁচটির বেশি বাঘ হত্যা করা হয়। পশুরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু তাদের বোবা কান্না প্রকৃতি ঠিকই শুনতে পায়। শুধু শুনতে পায় না বন ও বাঘ রক্ষার দায়িত্বে কর্তাব্যক্তিরা। ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, আগে এ বঙ্গ অঞ্চলে ছোট-বড় সব গ্রামীণ বন-জঙ্গল (কিছু দ্বীপাঞ্চল বাদে) ও অন্যান্য বনাঞ্চলে চিতা বাঘ বাস করতো। বাংলাদেশে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন বনে ৩০টির বেশি চিতাবাঘ রয়েছে বলে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের ধারণা। 

বাঘ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। বিভিন্ন যুগে বাঘ মানুষের ভয়, অনুপ্রেরণা ও শ্রদ্ধার কারণ হয়ে আছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বাঘ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলা সাহিত্যে বাঘের কথা এসেছে বহুবার। বাঘ বাংলাদেশ এর অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বাঘকে ভারত, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া জাতীয় পশুর মর্যাদা দিয়েছে। সুন্দরবনে বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বনে মা-বনবিবির পূজা করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলকে ‘টাইগার’ বলে সমীহ করা হয়। বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘বাঘের বাচ্চা’ বাগধারা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বাঘের বাচ্চা বলতে সাহসী বাচ্চাকে মূলত বোঝানো হয়ে থাকে। যারা সার্কাসকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন তারা বাঘ পোষেন। এ ছাড়া ধনী ব্যক্তিদের ঘরে বাঘ পোষার রীতি আছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের ঘরে ঘরে বাঘ পোষা হয়। বহুদেশের সংস্কৃতিতে বাঘের গুরুত্ব অপরিসীম। 

বন্যপ্রাণী পাচার থেমে নেই। চোরা শিকারিদের ধরে কঠোর শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্বস্তি ফিরবে না। এমনিতেই পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ুপরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বন ও বন্যপ্রাণীদের ওপর পড়তে শুরু করেছে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থেই বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ বেশ জোরোশোরে নেয়া হচ্ছে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ায় ‘বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে’ ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে। বাংলাদেশও এই সংখ্যা দ্বিগুণ করবে। কিন্তু সত্য হলো, বাংলাদেশ বাঘ রক্ষায় সঠিক পথে নেই। সুন্দরবন কেমন আছে তা বোঝা যায় বাঘের সংখ্যা দেখে। প্রয়োজনে যে সব দেশে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে সেসব দেশের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। বন রক্ষাসহ বাঘের বসতির নিরাপত্তা ও বাঘ রক্ষার তদারকি বাড়াতে হবে। বাঘ রক্ষার পাশাপাশি বাঘের সংখ্যা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে সুন্দরবন থেকে বাঘ চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে! বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই বাঘ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। 

লেখক: শিক্ষক

পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034139156341553