আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ভাষা গবেষণায় ফেলোশিপ চালু করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি মনে করি এই ইনস্টিটিউটের একটা দায়িত্ব সারা বিশ্বের যত ভাষা আছে সেই ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করা, এর ওপর গবেষণা করা, ভাষার ইতিহাস জানা, আমার মনে হয় এটি করা উচিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। তার জন্য যদি কিছু ফান্ড লাগে সেটিও আমি ব্যবস্থা করে দেব। গতকাল মঙ্গলবার মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ঢাকার সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি সব সময় গবেষণায় বেশি জোর দিই। কারণ গবেষণা ছাড়া কোনো বিষয়ে উৎকর্ষতা সাধন করা যায় না।’
অন্যান্য সব সেক্টরে গবেষণা জোরদারের ওপর গুরুত্ব তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা খুব বেশি দরকার।’
অনুষ্ঠান থেকে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মনোনীত তিন ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে মাতৃভাষা পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার আদায় করেছিল বাঙালি। তাই যারা ভাষা নিয়ে দৈন্যতায় ভুগছেন, তাদের বাংলা ভাষার ইতিহাস জানা প্রয়োজন। আজ আমাদের মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতি রক্ত দিয়ে মা ডাকার অধিকার পেয়েছিল আজকের এই দিনে। জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সংস্কৃতির ওপর অনেক আঘাত আনা হয়েছিল। আমাদের ভাষা পাল্টে দিয়ে অন্য ভাষা তুলে ধরা হয়েছিল।’
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষের কাজের সুবিধার জন্য আমরা ৯টি ভাষার একটি অ্যাপ করে দিয়েছি। ডিজিটাল সিস্টেমে যে কেউ যেন ভাষা শিখতে পারে, আমরা সে ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান। আরও বক্তব্য দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ সুসান মারি ভাইজ।
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার ‘বহুভাষিক বিশ্বে বহুভাষিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’র ওপর আলোকপাত করে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। এর আগে জাতীয় সংগীত এবং অমর একুশের সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের শিশুরা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শুভেচ্ছা জানায়।
মাতৃভাষা পদক পেলেন তিন ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠান : অনুষ্ঠানে তিন ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে মাতৃভাষা পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার এ পদক পেয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান (অতিরিক্ত আইজিপি) হাবিবুর রহমান, পদার্থবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক (কলেজের) ও গবেষক রণজিত সিংহ, ভারতের মাহেন্দ্র কুমার এবং পদকের জন্য মনোনীত প্রতিষ্ঠান কানাডার ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অ্যাসোসিয়েশন।
হাবিবুর রহমান ও রণজিত সিংহকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহেন্দ্র কুমার মিশ্র ও মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, কানাডা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সোসাইটির পক্ষে এর সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম পদক গ্রহণ করেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, বেদে জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে ভূমিকা রাখায় পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান এই পদক পান। এ বিষয়ে তার ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ নামে একটি বই রয়েছে। পদকে মনোনীত অন্যজন হচ্ছেন, রনজিত সিংহ পদার্থবিদ্যার একজন অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক (কলেজের) ও গবেষক। হারিয়ে যেতে বসা মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে কাজ করছেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ভাষায় সাহিত্যচর্চা, গবেষণা ও বই প্রকাশে তিনি অবদান রেখেছেন। ভারতের মাহেন্দ্র কুমার মিশ্র বহু ভাষার শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন। এ ছাড়া কানাডার ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অ্যাসোসিয়েশন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা আদায়ের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দে থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে এই পদক দেওয়া শুরু হয়। দুই বছর পরপর এই পদক দেওয়া হয়।