শুরু হচ্ছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার রক্ষার বিরল দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালিদেরই। ফেব্রুয়ারিতে আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি ভাষাসংগ্রামীদের। বাঙালির আত্নত্যাগ, আত্নমর্যাদা ও অহংকারের মাস ফেব্রুয়ারি। একুশ আমাদের আবেগ, অনুভূতি, প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রেরণা। কবি রামনিধি গুপ্তের ভাসায় ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’? স্বাধীনতা, সাম্য, মুক্তি ও গণতন্ত্রের শুভ সূচনার মাস ফেব্রুয়ারি। বায়ান্ন খ্রিষ্টাব্দে তরুণদের আত্নদানে ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লুকায়িত ছিলো। যা একাত্তরে পূর্ণতা পায়।
বাঙালির মনেপ্রাণে অস্তিত্বে জড়িয়ে আছে বাংলা ভাষা। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রতি ৩৬ জনে একজন এখন বাংলা ভাষায় কথা বলে। সে হিসেবে বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। কেউ কেউ বলছেন এ সংখ্যা এখন ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ভাষা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এথনোলগ গাইডের তথ্যমতে, বিশ্বের ১৯৫ দেশের ৭০০ কোটির বেশি মানুষ প্রায় ৭ হাজার ১৩৯ ভাষায় কথা বলেন। এখানে বাংলার স্থান চতুর্থ বা পঞ্চম। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পরে প্রশ্ন আসে আমরা মায়ের ভাষার সৌন্দর্য রক্ষায় কী করেছি? ভাষা শহীদদের স্বপ্নের ভাষার মর্যাদা কী আমরা বহন করছি? বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দরদই বা কতোটুকু?
নানান আগ্রাসী বিকৃতি থেকে আমরা বাংলাকে হেফাজত করতে পেরেছি? সন্তানদের ইংরেজি শেখানোর জন্য অভিভাবকরা যতোটা দুশ্চিন্তা করেন তার সিকিভাগ চিন্তাও কি তারা করেন বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ কিংবা শুদ্ধ বাংলা লিখা নিয়ে? বাংলা-ইংরেজির মিশেলে ছড়িয়ে পড়া ‘বাংলিশ’ অনেকটা গর্বের তো বটেই! ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ একটু বাড়ে বৈকি! বর্ণমালা খচিত ব্যানার-পোস্টার না শাড়ি-পাঞ্জাবিও লাগে। আনুষ্ঠানিকতা বা বাধ্যতামূলক কর্মসূচি পালন করে ফটোসেশন, ফেসবুকে আপলোড। ব্যাস! কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস শুরু এলে ভাষা নিয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনাও যেন ১১ মাসের ঘুম থেকে জেগে ওঠে’। সৈয়দ আবুল মোমেন বলেন, ‘ইংরেজি-হিন্দির ভিড়ে বাংলা এখন শঙ্কার ভাষা’। বাংলা ভাষা নিয়ে সর্বত্র একটা বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যায়।
সাইনবোর্ড, পরিবহন, গণমাধ্যম বিশেষ করে অনলাইন পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে, রেডিও-টিভিতে বাংলা ভাষার বিশ্রী চেহারা ভেমে ওঠে। বিজ্ঞাপন আর সস্তা বিনোদনে বাংলা ভাষার বারোটা বেজে গেলেও তা দেখার বা শোনার কেউ নেই। কেউ কেই বলেন, এটা বিকৃতি না বহমানতা। আমাদের মনে রাকতে হবে ভাষার নিজস্বতা বা নিজস্ব সংস্কৃতির চেয়ে বড় সংস্কৃতি আর কিছু নেই। আমরা কী ভাষাকে বেগবান বা স্বাস্থ্যবান করতে পেরেছি? নাকি উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাকে উপযুক্ত করেছি? বিকৃতি থেকে বাঁচানোর জন্য শুদ্ধতাকে দৃশ্যমান রেখেছি? ‘ছ্যাকা খাওয়া’, ‘মাঞ্জা মারা’, ‘জোশ লাগা’র মতো ‘পাতলা মারা’কে আমরা জেনেশুনেই গ্রহণ করছি! ভাষা এবং উপভাষাকে আমরা এক কাতারে নিয়ে এসেছি। ভাষার নানান রূপ থাকে। আঞ্চলিক, বৈঠকি, পারিবারিক ও বন্ধুত্বের মহলের ভাষার ওপরে স্থান দিতে হবে ‘প্রমিত বাংলা’কে। প্রমিত ভাষাকে।আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি অন্যান্য ভাষার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। তাই বলে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে বাংলা বললে জরিমানা গোনার মতো দৃষ্টতা দেখাতে হবে! এটা কোনো ভাষার প্রতি ভালোবাসা না উন্মাদনা। ভাবাবেগ ছড়ালে লাভ হবে না। ভাষা নদীর মতো হলেও এর নিজস্বতা ছিলো, আছে এবং থাকবে। ফেব্রুয়ারি শেষ হলেই ভাষার প্রেম যেনো আমাদের নিঃশেষ হয়ে না যায় সেটাই কাম্য।
লেখক: অধ্যক্ষ, জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।