আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় গণমাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের প্রকাশ্য ঘোষণার সমালোচনা করেছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
তারা এটিকে ‘একজন বিদেশি কূটনীতিকের দ্বারা দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর নজিরবিহীন আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছেন।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এই বিষয়ক একটি প্রশ্নের জবাবে ‘গণমাধ্যম’র বিষয় উল্লেখ করেননি। অথচ রাষ্ট্রদূত হাস এক টিভি সাক্ষাত্কারে বলেছেন, গণমাধ্যমও নতুন ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে পারে।
রাষ্ট্রদূতের গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করা এই মন্তব্যকে কিছু জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবমাননা’ বলে অভিহিত করেছেন।
খালেদা জিয়ার প্রাক্তন প্রেস কর্মকর্তা মুশফিক ফজল আনসারী ‘স্বাধীন গণমাধ্যমকে’ ‘সরকারের হাতিয়ার’ হিসেবে বর্ণণা করায় তার তীব্র সমালোচনা করেন সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদরা।
তারা আরও বলেছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের আগে ‘বিরোধীদের পক্ষে’ কাজ করানোর জন্য মিডিয়া আউটলেট মালিকদের ও সাংবাদিকদের আরও বেশি ভয় দেখানো।
সব ধরনের সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড- একটি বিবৃতিতে জানায়, ‘সাংবাদিকদের উপর ভিসা বিধিনিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্তিবিষয়ক রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে জনগণের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার এবং গণমাধ্যমের উপর অদৃশ্য সেন্সরশিপ আরোপ করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। যা গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রধান স্তম্ভ মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগের বক্তব্য ও পরের বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল যে ‘গণমাধ্যমকে বাধা দেওয়া বা ভয় দেখানোর জন্য দায়ী’ অর্থাৎ, গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া ব্যক্তিরা ভিসা বিধিনিষেধের মুখোমুখি হবে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রদূত হাসের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের আগের অবস্থান থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কথা বলে।
তিনি আরও বলেন, ‘যদিও তারা আগে বলেছিল গণমাধ্যমের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের শাস্তি দেওয়া হবে, এখন আমরা তাদের আগের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ ইউ-টার্ন দেখতে পাচ্ছি। এটি বাস্তবায়িত হলে, স্বাধীন সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে এটি।’
কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবীণ সাংবাদিক বলেছেন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র এই বিষয়ে কথা বলার সময় গণমাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
তিনি আরও বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি করে। এখন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর হাসের ঘোষণার সম্ভাব্য প্রভাব দেখা বাকি আছে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তবিউর রহমান প্রধান প্রশ্ন রেখেছেন, ‘একইসঙ্গে আপনারা কীভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে অন্যদের পরামর্শ দিতে পারেন এবং গণমাধ্যমকে ভিসা বিধিনিষেধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন?’
অন্যদিকে, মানবাকারকর্মী সুলতানা কামাল একজন টিভি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেছেন, ‘একটি দেশের ভিসা বাতিল করার অধিকার আছে। তবে তারা ভিসা দেবে না- এমন একাধিক পূর্ব ঘোষণার পেছনে কী উদ্দেশ্য রয়েছে তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।’
তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘোষণা জারি করার এই ধরনের পদক্ষেপ কি সত্যিই কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে সমর্থন করে?’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঘোষণার পর বিএনপি ও জামায়াতপন্থী বেশ কয়েকজন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ও নেতা কিছু মিডিয়া আউটলেটের সমালোচনা করেন এবং দলগুলোর সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের জন্যও বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নামও উল্লেখ করেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ও তাদের সমর্থকদের শেয়ার করা ভিডিওগুলোতে তারা ভিসা বিধিনিষেধে গণমাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিএনপি বর্জন করেছে এমন বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের নাম উল্লেখ করেছে।
এ ছাড়াও, জামায়াতে ইসলামের একটি এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্ট ‘বাঁশেরকেল্লা’তে পোস্ট করা একটি টুইটে বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত হাস ‘বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু।’
এই বিশেষ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টটি সংখ্যালঘু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ‘ঘৃণাত্মক প্রচারণা’ চালানোর জন্য সংবাদ তৈরি করেছে।