ছাত্রীর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ২৭ কোটি টাকার হোস্টেল। এ ঘটনা রাজধানীর মনিপুর হাইস্কুলের। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক তদন্ত প্রতিবেদনে স্কুল কর্তৃপক্ষের অযথা ও অপরিকল্পিত অর্থ খরচের এই চিত্র উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে এ প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা হয়। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এই তদন্তকাজ পরিচালনা করা হয়। এরপর কয়েক মাস তথ্য যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করে তদন্ত দল। এতে শতকোটি টাকার অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। তদন্তের কপি দৈনিক শিক্ষাডটকমের হাতে এসেছে।
স্কুল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রীদের আবাসিক সুবিধার জন্য এই হোস্টেল নির্মাণ করা হয়নি। সবাই জানে, এই হোস্টেলে কোনোভাবেই আবাসিক ছাত্রী পাওয়া যাবে না। আশপাশের এলাকার শিক্ষার্থীরা নিজ বাসায় থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। মূলত বড় অঙ্কের টাকা খরচের জন্য এই হোস্টেল নির্মাণ করা হয়েছে। কারণ যত বেশি টাকা খরচ করা সম্ভব হবে, তত বেশি টাকা নয়ছয়ের সুযোগ তৈরি হবে।
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ২০১৮ সালের বিল, ভাউচার ও স্টেটমেন্ট যাচাই করে পরিদর্শন দল দেখতে পায়, অধ্যক্ষের বাসভবন ও মহিলা হোস্টেল নির্মাণকাজের ব্যয় বাবদ লারা এন্টারপ্রাইজকে মোট ৩১ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯৯৯ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এর মধ্যে ৪ কোটি অধ্যক্ষের বাসভবন ও ২৭ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯৯৯ টাকা মহিলা হোস্টেল নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে। গত বছরের ৯ জুন মহিলা হোস্টেলে অবস্থানরত ছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ১৩ জন; অর্থাৎ ৫০০ সিটের মধ্যে ৪৮৭টিই ফাঁকা। এতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। ফলে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই মহিলা হোস্টেল নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করা হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।কয়েক দিন আগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন সেই ১৩ জন ছাত্রীও হোস্টেলে নেই। মাত্র চার-পাঁচজন অবস্থান করছে। অথচ তাদের পেছনে আট-দশ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী কাজ করছেন। মাসে অনেক টাকা মেইনটেন্যান্সে খরচ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘ভবিষ্যতের চিন্তা করে হোস্টেলটি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে একটি উইমেন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। সেটা হলে হোস্টেলটি প্রয়োজন হবে।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোস্টেলটি করা হয়েছে স্কুলের টাকায়। তাহলে সেটা কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ব্যবহৃত হবে?
প্রতিবেদনে জানা যায়, আট বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩৫ কোটি ৩ লাখ ৯২ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার কর ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এ ছাড়া ৩১ কোটি ৬৮ লাখ ৮ হাজার ৯৫৩ টাকার কাজের প্রয়োজনীতা ও যথাযথ হিসাব দিতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। ৭ বছরে আইন ভেঙে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্মানী নিয়েছে। বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষকদের নামে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। ৬ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ম্যাগাজিন ফি বাবদ ৩ কোটি টাকা তোলা হলেও বের হয়নি ম্যাগাজিন। এমনকি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের নামেও দুর্নীতি হয়েছে। ৭ বছরে প্রায় পৌনে ৪০০ কোটি টাকার মতো বিভিন্ন ধরনের কাজের বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অবস্থিত মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ৬টি ক্যাম্পাস। মনিপুর এলাকায় বালক ও বালিকাদের জন্য পৃথক ক্যাম্পাস রয়েছে। এর বাইরে শেওড়াপাড়া, ইব্রাহীমপুর ও রূপনগরে শাখা রয়েছে। আর রূপনগরে আলাদাভাবে করা হয়েছে কলেজ ক্যাম্পাস। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ হাজারের ওপরে। প্রতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসের টিউশন ফি, ভর্তি ও সেশনচার্জ বাবদ প্রতিষ্ঠানটিতে এককালীন আয় হয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে প্রতি মাসে টিউশন ফি বাবদ ওঠে প্রায় ৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটির আয় প্রায় ১১৭ কোটি টাকা।
দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরে ১১৭ কোটি টাকা আয় হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ ৩০ কোটি খরচ করাই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বাকি টাকায় সারা বছরই চলে নানা ধরনের উন্নয়নকাজ ও নানা ধরনের কেনাকাটা। এমনকি নতুন ভবন ভেঙেও তৈরি করা হয়েছে আরেক নতুন ভবন। প্রতিষ্ঠানটির বালিকা ক্যাম্পাসের চারদিক ঘুরিয়ে ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল ছয়তলাবিশিষ্ট ভবন। কয়েক বছর ধরে সেই ভবন ভেঙে নতুন তিনটি ১৫তলা ভবন নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। এগুলো নির্মাণের জন্য আগে ৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হলেও সম্প্রতি তা বাড়িয়ে ১৩০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়ার পরও নিয়ম ভেঙে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস থেকে ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। যাদের অধীনেই চলছে প্রতিষ্ঠানটি। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার, যিনি সর্বশেষ গভর্নিং বডিরও সভাপতি ছিলেন। সদস্য সচিব অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে রয়েছেন বর্তমান সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী মো. কামাল আহম্মেদ মজুমদার, এ কে এম দেলোয়ার হোসেন, তৌহিদুল ইসলাম, জাকিয়া শিল্পী, ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ড. মো. শহিদুল্লাহ্ শিকদার এবং রেজাউল হক ভুঁঞা।
ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত গভর্নিং বডির সভাপতি, সদস্য ও সদস্য সচিবের সম্মানী বাবদ ১ কোটি ৫৪ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৪ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সম্মানী থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করার কথা। সেই হিসাবে সম্মানী থেকে সরকার বঞ্চিত হয়েছে ১৫ লাখ ৪১ হাজার ৯৬৪ টাকা। এ ছাড়া গভর্নিং বডি প্রবিধানমালা ২০০৯ অনুযায়ী, সদস্যদের সম্মানীর বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। যেহেতু সম্মানী নেওয়ার সপক্ষে কোনো বিধান নেই, তাই সম্মানী বাবদ গৃহীত সব টাকা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে ফেরত দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মূল ক্লাসের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস নেওয়া হয়। এসব ক্লাসের সম্মানী বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ২০ কোটি ৯০ লাখ ২৭ হাজার ৫৬ টাকা। কিন্তু এই সম্মানীর বিপরীতে ১০ শতাংশ উৎসে কর বাবদ ২ কোটি ৯ লাখ ২ হাজার ৭০৫ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এতে সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অভিভাবকরা বলেছেন, ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা শুরু হলে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ ছিল মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ। তখন নিয়মিত ক্লাস না হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকদের বেতনও আংশিক দেওয়া হয়। অথচ করোনাকালীন ২০২০ ও ২০২১ সালে যেখানে নিয়মিত ক্লাসই হয়নি, সেখানে বিশেষ ক্লাসের নামে বড় অঙ্কের বিল দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃক নিযুক্ত হোসেন দেলোয়ার অ্যান্ড কোং-এর অডিট রিপোর্ট যাচাই করে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সরবরাহ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩১৪ কোটি ৭ লাখ ২৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এর বিপরীতে মাত্র ১ কোটি ২৪ লাখ ২২ হাজার ৯৭৫ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ রাজস্ব বোর্ডের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ভ্যাট হওয়ার কথা ২৩ কোটি ৫১ লাখ ৪৯ হাজার ২৬২ টাকা। তাই বাকি ২২ কোটি ২৭ লাখ ২৬ হাজার ২৮৮ টাকা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হওয়া আবশ্যক।
বিদ্যালয়টির ইব্রাহীমপুর ক্যাম্পাস মেরামত ও রং করার কাজে ভয়াবহ অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে পরিদর্শন দল। তারা বলছে, ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর একুলিয়া এন্টারপ্রাইজকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ১ কোটি ১৭ লাখ ৬৭ হাজার ৯১০ টাকার কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু কার্যাদেশ পাওয়ার মাত্র ৭ দিনের মাথায় বিল পরিশোধের সুপারিশ করা হয়। অথচ ইব্রাহীমপুর ক্যাম্পাসটি অনেক বড় এলাকা। মাত্র ৬ দিনে এর নির্মাণ, মেরামত ও রং এর কাজ করা সম্ভব নয়। তাই কাজটি আদৌ করা হয়েছিল কি না, তা সন্দেহজনক। আর একুলিয়া এন্টারপ্রাইজের ট্রেড লাইসেন্স যাচাই করে দেখা যায়, এটি একটি আমদানি-রপ্তানিকারক ও তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের এ ধরনের কাজ করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
২০১৫-১৬ হতে ২০২১-২২ অর্থবছরের বিল ভাউচার যাচাইয়ে আরও দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জারা এন্টারপ্রাইজ, লারা এন্টারপ্রাইজ, তৌহিদ ডেভেলপারস অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, ওশান ইনফরমেশন সিস্টেম ও মনির ডেকোরেটরকে মোট ৪৭ কোটি ২১ লাখ ৬৩ হাজার ১৩৩ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ এসব বিল বাবদ ১০ কোটি ৫২ লাখ ২১ হাজার ৯৫৬ টাকার আয়কর পরিশোধ করা হয়নি। দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আয়করের পুরো টাকা আদায় করে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রতিস্থাপনেও ২ লাখ ৭৭ হাজার ১৯২ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে; যা বিধিবহির্ভূত বলেছে পরিদর্শন দল।
নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিক্ষক বলছেন, ঘুরেফিরে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই স্কুলের শত শত কোটি টাকার কাজ করছে। বলতে গেলে, কয়েকজন ট্রাস্টির সৃষ্ট ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের মাধ্যমেই বড় অঙ্কের টাকা নয়ছয় হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির এত ভবনের কী দরকার? প্রতিনিয়ত নতুন ভবন ভেঙে আবার ভবন করা হচ্ছে। ভবন নির্মাণ আর কেনাকাটার মাধ্যমেই লুটপাট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
এর আগে গত অক্টোবরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড গঠিত অপর এক তদন্তে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনি ইতিমধ্যে আড়াই বছর ধরে অবৈধভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। অবসরের পর প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি বা ট্রাস্ট তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলেও তা বৈধ নয় এবং তারা তা দিতে পারে না। কিন্তু এরপরও ফরহাদ হোসেন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।