আপনি প্রতিদিন কতো ঘণ্টা স্মার্টফোন চালান? অনলাইনে আপনি কী কী করেন? আর আপনার সঙ্গে কী কখনো এমন হয়েছে যে একটানা ফোন চালাতে চালাতে এক ঘণ্টারও বেশি পাড় করে ফেলেছেন?
এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করেছিলাম বেশ কয়েকজনকে। তারা ফোনের ডিজিটাল ওয়েলবিয়িং ফিচারের স্ক্রিনশটসহ উত্তর দেন। হিসেব করে দেখা গেছে, তারা প্রত্যেকে গড়ে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট ফোন চালান। এদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন, তারা প্রতিদিন কমপক্ষে ১৪ ঘণ্টা ফোন চালান। সর্বোচ্চ ১৭ ঘণ্টা ফোন চালানোর কথাও কয়েকজন জানান। জেনে রাখা ভালো, উত্তরদাতারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
অধিকাংশ দেশেই অফিসে দৈনিক আদর্শ কাজ করার সময় প্রায় ৮ ঘণ্টা। তবে ফ্রান্সে এ সময় ৭ ঘণ্টা এবং উত্তর কোরিয়ায় ১৫ ঘণ্টা করা হয়েছে। তাই এতো সময় ধরে আপনি যদি কাজ না করেন, কিংবা চাকরির প্রস্তুতি না নেন তাহলে আপনি বেকার থাকবেন নিশ্চিত। আপনি যদি প্রতিদিন এতো সময় কোনো ব্যবসার পেছনেও দেন তাহলে সে ব্যবসা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফুলেফেঁপে উঠবে।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মাইকেল গোল্ডহাব সর্বপ্রথম ওয়াইয়ার্ডে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন ঘটেছে। বহুসংখ্যক কর্মী এখন আর বস্তুগত দ্রব্যের সরাসরি উৎপাদন, পরিবহন এবং বণ্টনের সঙ্গে যুক্ত না। পরিবর্তে তারা কোনোনা কোনো প্রকার তথ্য নিয়েই কারবারি করছে, সেগুলো পরিচালনা করছে এবং সেখান থেকেই আয় করছে। অনেকেই এটাকে তথ্যের অর্থনীতি বলেন। কিন্তু গোল্ডহাব বিষয়টাকে অন্যভাবে ব্যাখা করেন।
তার আগে অর্থনীতির সংজ্ঞাটা বুঝে নেয়া যাক। অর্থনীতির সংজ্ঞানুযায়ী কীভাবে দুষ্প্রাপ্য সম্পদ কাজে লাগিয়ে সমাজে কোনোকিছু করা যায় তা নিয়েই অর্থনীতিতে আলোচনা করা হয়। আপনি ইন্টারনেট থেকে কোন ধরনের তথ্য খুঁজে পেতে চান, কোন পণ্য কিনতে চান, কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে চান কিংবা কোনো মানুষ সমন্ধে জানতে চান। সবকিছুই কিন্তু কয়েক সেকেন্ডেই করে ফেলা যাচ্ছে। আর গোল্ডহাব বলেন, বিনিময়ে কোনো কিছু না পাওয়া গেলে কেউ ইন্টারনেটে কখনোই কোনো কিছু দিত না। সেই কোনো কিছুটাই হলো মনোযোগ।
আর এই যুগে যে অর্থনীতি চলছে সেটা হচ্ছে মনোযোগের অর্থনীতি। এটাই ইন্টারনেট জগতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। প্রযুক্তির সঙ্গে চিপকে থাকার জন্য আমাদের হাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টাই সময় থাকে। আর এই সময়েই তুলে ধরা হয় অসীম তথ্যের ভান্ডার।
আরেক শিক্ষার্থী সোহানা আক্তার রিয়া প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ফোন চালান। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ইন্টারেস্টিং কোনো কারণ নেই। সারা দিন কিছু করার থাকে না। এটা সময় কাটানোর সহজ উপায়।
আমরা এই মনোযোগের অর্থনীতিতে বসবাস করছি। আপনি অনলাইনে যতো সময় কাটাবেন, অনলাইনে দেয়া বিজ্ঞাপনের দিকে যতোই মনোযোগ দেবেন ততোই ব্যবসায়ীদের লাভ হবে। আর যারা মানুষের এই অনলাইনে সময় কাটানোর অভ্যাস তৈরি করতে পারবে তারাই এই অর্থনীতিতে কর্তৃত্ব লাভ করবে। তাই ইউটিউবে ঢুকলেই আপনি দেখবেন মসলাদার টাইটেল ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের কিছু কিছু পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল কেনো এতো জনপ্রিয় ভেবে দেখেছেন? রাজনীতিতেও এখন নীতি নির্ধারণ করাটা কোনো বিষয় না, কে জনগণের কতোটা মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন সেটাই আসল বিষয়।
নেটফ্লিক্সের মতো দেশীয় স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে অটোপ্লে ফিচার কেনো দেয়া হয়েছে? কেনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রলিং করার কোনো সীমা থাকে না? সে আপনি জুসের বিজ্ঞাপনই দেখেন, কিংবা স্পোকেন ইংলিশের বিজ্ঞাপনই দেখেন; স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে পারেন না কেনো? তথ্যের কথা বাদ দিলাম, আপনি ইন্টারনেটে যা যা দেখেন সেগুলো কি আপনার জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক?
এ বিষয়ে ঢাবির আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের শিক্ষার্থী মুহম্মদ সজীব হোসেন বলেন, সকাল-বিকাল সবসময়ই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকি। মোবাইল টিপতে টিপতে বিরক্ত হলে তখন আবার কম্পিউটার এ চোখ আটকাই।
ব্রিটিশ গবেষক স্টেসি জো ডিক্সনের মতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে মেটার আয় দাঁড়ায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে মেটা বিজ্ঞাপন থেকে প্রায় ১৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে মেটার বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের পরিমাণ ছিলো ১১৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অনেকেই টিকটক নিয়ে হাসাহাসি করেন। টিকটকের বাৎসরিক আয় সম্বন্ধে জানেন তো? গবেষক ভ্যালেন্টিনা ডেনচেভা জানান, যে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে টিকটক বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপন চালিয়ে ৩ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ধারণা করা হচ্ছে চলতি বছরে এ আয় গিয়ে পৌঁছাবে ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
টাকাগুলা কারা দিচ্ছে জানেন? আপনারাই দিচ্ছেন। কেনো দিচ্ছেন জানেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে আপনি তাতে মগ্ন থাকেন। আধুনিকতার জোয়ারে গা ভাসাতে গিয়ে আমরা আমাদের মূল্যবান সময়গুলো কীভাবে হারাচ্ছি তা নিজেরাই বুঝতে পারছি না। প্রতিদিন আমাদের মনোযোগ বিনামূল্যে বিলিয়ে দিচ্ছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ইন্টারনেটের কাছে।
লেখক: ছাত্র, ৩য় বর্ষ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাবি