মানুষ ভাষার জন্য স্বকীয় - দৈনিকশিক্ষা

মানুষ ভাষার জন্য স্বকীয়

এম এ কবীর |

ভাষার কারণেই মানুষ অন্য সব প্রাণি থেকে ভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। ভাষা হলো চিন্তার বাহন। মানুষ যা চিন্তা করে সেসব চিন্তা ও অনুভূতি ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে। আর অসংখ্য ভাষার ভেতর প্রত্যেক মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার মাতৃভাষা। জন্মের পর পর যে ভাষা সে তার আশপাশে শুনতে পায়, তার মায়ের মুখ থেকে শুনতে পায়, তাই হলো মাতৃভাষা। ভাষাই মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। কল্পনা আর অনুভূতিকে অক্ষরের অসীম বিন্যাসে সাজাতে পারার সক্ষমতা অকিঞ্চিৎকর প্রাণিটিকে দিয়েছে দুনিয়া তছনছ করে ফেলার শক্তি। ফলে ভাষার বিকাশ এবং মানুষের সভ্যতার বিকাশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়া, দুনিয়ার নানা বিষয়ের সঙ্গে তার যোগসাজশেই শব্দের জন্ম হয় আর এর চর্চা একে শাণিত করে। নানা এলাকার মানুষ যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, ভাষাও সেভাবেই গড়ে ওঠে। যেমন বলা হয়, এস্কিমোরা নাকি নানা ধরনের বরফ ব্যবহারে অন্তত ৪০ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন। বরফের গড়ন, রং, ধারণক্ষমতাসহ নানা বৈশিষ্ট্যে ভাগ হয়। আমরা যারা জীবনে বরফই দেখিনি, তাদের কাছে এ ব্যাপারটা কল্পনা করাও কঠিন। অন্যদিকে, এস্কিমোরা এতো এতো শব্দ ব্যবহার করলেও শুধু ‘বরফ’ বলার জন্য কোনো আলাদা শব্দ ব্যবহার করে না। কারণ, বরফ তাদের জীবনের এতোটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ যে, সে আলাদা করে এর নাম না দিয়ে এর নানা বৈচিত্র্যকে নাম দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছে। ঠিক একইরকম ব্যাপার আমরা দেখতে পাই বৃক্ষের বেলায়, প্রাণির বেলায়। 

কোন ফলটি সুস্বাদু, কোন ফলটি বিষাক্ত, কোনটি কোন মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, এসবের ওপর ভিত্তি করে তারা খাবার সংগ্রহ করতেন। এর সঙ্গে যদি যুক্ত করি বিভিন্ন প্রাণির নাম, কোনটি বিপজ্জনক, কোনটি শিকারযোগ্য আর জায়গার নাম সেসব জায়গায় বৈশিষ্ট্যের নাম। এ শ্রেণি-বিভাগ আদিম মানুষের একদম প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা ছিলো। এ জ্ঞান ছিলো জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি। বিজ্ঞানীদের মতে, আদিম মানুষের যে মেন্টাল ম্যাপিং, তা আধুনিক যুগের মানুষের চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। এ চর্চা তার মস্তিষ্ককে সমৃদ্ধ করেছে। মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখান যে, বহুভাষাবিদদের বুড়ো বয়সে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। বহুভাষার চর্চা মানুষের মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত ও ক্ষুরধার করে। প্রকৃতির কথা তো বলাই হলো। মানুষ তো দিনশেষে প্রকৃতিরই অংশ। 

আমরা যাদের ‘অসভ্য’ বলি, তাদের ভাষায় কেবল যে প্রাচীন জ্ঞান লুকানো তাই নয়, এতে আছে আধুনিক বিজ্ঞানেরও সূত্র। একেকটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে আমাদের বিজ্ঞানের একটা অংশ খসে যাওয়া।

শুধু পরিবেশ নয়, এমনকি প্রযুক্তির উৎকর্ষের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষায়। কারণটা সহজেই বোঝা যায়। একেক এলাকায় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে একেক এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাষা গড়ে উঠেছে। এস্কিমোদের উদাহরণ থেকেই বলা যায়, প্রকৃতিকে ঠিকঠাকভাবে বুঝতে, ভূমির অভ্যন্তরে ও ওপরে লুকিয়ে থাকা অসীম শক্তি ব্যবহার করতে স্থানীয় ভাষা হাজার হাজার শব্দ তৈরি করেছে। এ ভাষাগুলোর হারিয়ে যাওয়া আমাদের ভবিষ্যতের জন্য বিপদ। মুশকিল হচ্ছে, বিশ্বায়নের দুনিয়ায় আমরা যোগাযোগের সুবিধার্থে একক ভাষার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। ক্রমেই ইংরেজি হয়ে উঠছে একমাত্র ভাষা। 

ভাষা চাপিয়ে দেয়ার যে আধিপত্যবাদ তা রুখে দিয়েছি। এ আন্দোলন ছিলো আমাদের মুক্তির, নিজেদের দেশ পাওয়ার মূল ভিত্তি। ডেভিড বিভার আর জেসন স্ট্যানলির সুলিখিত বই দ্য পলিটিকস অব ল্যাঙ্গুয়েজে এ নিয়ে বিশদ জানা যায়। আর এ শতকে এসে আমরা এ আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি বৈশ্বিকভাবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ব্যাপারটা শুধুই একটি দিবস নয়, বরং আমাদের অস্তিত্বের জন্য জরুরি। অন্য ভাষাকে দমন করে, নির্দিষ্ট একটা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা শুধুই যে ওই ভাষাটিকে হত্যা করে, আমাদের জ্ঞানের আধার ধ্বংস করে তাই না; এর অন্য একটা ভয়াবহ দিক আছে। 
ইসলামি বিশ্বাস মতে প্রতিটি ভাষাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি, ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। আমাদের নবী মোহাম্মাদ (সা.) পৃথিবীতে মানব জাতির শেষ নবী। এই যুগটা জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে উৎকর্ষ লাভ করে। তাই আমাদের নবীজি (সা.) এর মুজেযা দেয়া হয় ভাষা কেন্দ্রিক। পবিত্র কোরআনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ভাষা সাহিত্য ও অলংকার। কোরআন যাদের জন্য নাযিল হয়েছে তাদেরও ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

আমাদের বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে যে, কোনো ভাষাকে হেয় করে দেখা ঠিক নয়। বিশেষত মাতৃভাষাকে প্রত্যেক মুসলিমের গুরুত্ব দেয়া উচিত। ঠিকঠাক মাতৃভাষা চর্চা না করলে মেধা পূর্ণ বিকশিত হবে না। শুধু কি তাই নিজের ভাষা আয়ত্ব না হলে আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে চাইতে পারবে না এবং হৃদয়ের সুকোমল বৃত্তিগুলোর বিকাশও ঘটবে না। এ কারণে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের নতুন এক চেতনা ও মূল্যবোধের জন্ম দেয়। বুঝেছিলাম জাতি হিসেবে আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার মর্যাদা আদায়। ভাষা-কৃষ্টি প্রত্যেক জাতির প্রকৃষ্ট সম্পদ। আর তাই আমাদের এই মাতৃভাষার ওপর শত্রুরা যখন আক্রমণ চালায় তখন আমরা রুখে দাঁড়াই। যেহেতু ভাষা বা সংস্কৃতি থেকে পৃথক হয়ে জাতি হিসেবে আমাদের কোনো অস্তিত্ব ভাবা সম্ভবপর ছিলো না, সেহেতু আমরা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বাধিকার আদায়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই। তৎকালীন সমাজে বাঙালিরা রাজনৈতিক চেতনায় প্রখর ছিলো না। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি তাদের সে মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। ভাষার স্বাধিকার আদায় থেকে শুরু করে একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি আমরা তাই পরবর্তীকালে করি। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা কতোখানি প্রখরতা লাভ করলে আমরা এতোখানি পথ পরিক্রমের স্বপ্ন দেখি এবং পথ পাড়িও দেই তার মর্ম উপলব্ধির মধ্যে একুশের চেতনার মাহাত্ম্য নিহিত।

লেখক: সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027370452880859