ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করেছি, সেখানকার অবস্থা, পরিবেশ, পড়াশোনার ধরন সবই আলাদা। কাজেই ক্যাডেটদের নিয়ে লিখতে চাই না। অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের প্রায় সবাই দেশ ও বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে অত্যন্ত মেধাবী ও চৌকস ক্যাডেটদের অধিকাংশই আত্মকেন্দ্রিক। দেশ তাদেরকে যা দিয়েছে সে বিষয়টির প্রতি তাদের খুব একটা ঋণ শোধ করার তাড়া দেখা যায় না। কবে, ডিফেন্স অফিসার হবেন কিংবা বিদেশে যাবেন এই চিন্তাটাই অনেকের মধ্যে বেশি। তারপরেও তারা তাদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও দেশ ও মানুষের সেবা করতে পারেন এবং অনেকে করছেনও। আর এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্ক সব সময় খুব মধুর হয় না। কারণ, ওই বয়সের শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুই করতে চান কিন্তু নিয়মের বাধায় তা করতে পারেন না আর নিয়ম প্রয়োগ করার জন্যই রয়েছে ফ্যাকাল্টি মেম্বাররা। তাই নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে ক্যাডেটদের পছন্দের তালিকায় ফ্যাকাল্টি মেম্বাররা থাকতে পারেন না।
আমি যখন রাজউক কলেজে শিক্ষকতা করি তখন এখানকার এক ছাত্র শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। তখনো এতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি। একদিন কলেজে এসেছেন এবং আমি তার পড়াশোরা কথা জিজ্ঞেস করায় উত্তরে তিনি বললেন, অনেকটা অবজ্ঞার স্বরে, যে শাবিপ্রবি-তে ভর্তি হয়েছেন, সেটি যেনো শুধু মামুলি ব্যাপার, প্রেস্টিজেরও ব্যাপার নয়। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো স্যার, আমি দেশের বাইরে চলে যাবো, ওখানে পড়বো না। দেশের নামকরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা তার কাছে অপমানের মনে হয়েছে। ওখানে থেকে বা পড়ে কী হবে! ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তিনি ধরে নিয়েছেন ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিছু হবে না। ছেলেটির চোখে-মুখে দেখলাম হতাশার ছায়া। তারই আর এক ক্লাসমেট স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডন চলে গেছেন। সেখান থেকে মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দিতেন, কী পড়ছে, কেমন আছে, কী কী সমস্যা ফেস করছে ইত্যাদি নিয়ে কথা হতো। তিনি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ফলের দোকানে কাজ করেন, তার গায়ের চামড়া শাদা নয় বলে তাকে কিছুটা তাচ্ছিল্যভাবের আচরণ সহ্য করতে হয় সর্বত্রই এবং কায়িক শ্রমের পারিশ্রমিকও সেই হারে নির্ধারিত। বললেন স্যার, এ বিষয়টি এখানে আছে এখনো।
এদেশের মানুষের অবস্থা ভালো নয়, অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, দেশ ও মানুষের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়, স্পষ্ট নয় তাই হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ বৈধ অবৈধ উপায়ে, সাধারণভাবে, অসাধারণভাবে পাড়ি জমিয়েছে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে। তাদের এবং শুধুমাত্র কাজ নিয়ে বিভিন্নদেশে যাওয়া প্রবাসীর সংখ্যা এক কোটি ৪৯ লাখের মতো। তারা অপেক্ষা করেনি দেশের ভালোর জন্য, দেশে বসে তারা খুব একটা কিছু করতে পারেননি। তাদের অনেকে আবার স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী বলে থাকেন। আমি সেটি বলতে চাচ্ছি না। কারণ, দেশ তো আসলেই তাদের মনে কোনো আশা জাগাতে পারেনি। দেশ অনেক মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে পারেনি। তাই ভালো কিছুর আশায় তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। পাড়ি জমিয়ে তারা তো শুধু সেখানে বসে খাচ্ছেন তা তো নয়, তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সই আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে, দেশের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছে অনেকটাই শক্ত ভিত্তির ওপর যদিও দেশের অপরাজনীতি বিষয়টিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। দেশের বাইরে যাওয়া সেটা পালিয়েই হোক আর সাধারণভাবেই হোক মানুষগুলোই আজ দেশে কোটি কোটি ডলার পাঠাচ্ছেন আর আমরা তার বাহবা নিচ্ছি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোনো প্রচেষ্টা বা পদক্ষেপ বিষয়টকে আজও সহজ করতে পারেনি বা সেই অর্থে কোনো ধরনের সহায়তাও করতে পারেনি। না তাদের যাওয়ার আগে, না যাওয়ার পরে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের কি দেশের জন্য ভালোবাসা নেই? অবশ্যই আছে।
ঋক একজন বাংলাদেশি শিশু, থাকেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। তিনি বাবা-মার সঙ্গে বাংলাদেশে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। সে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে তার দাদা-দাদু এবং চারপাশের মানুষদের খুব ভালো লেগেছে। তাই তিনি বলছেন অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি তার ভালো লাগে না, বাংলাদেশকে ভালো লাগে। বাংলাদেশের মানুষদের তার ভালো লাগে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বস্বীকৃত উন্নয়নশীল দেশ। যেখানে সমস্যা থাকার পরও মানুষ দেশের টানে এক ও অভিন্ন। ইতিহাস বলে যে, এ জাতি ইচ্ছে করলেই অনেক বড় ধরনের কাজ করে ফেলতে পারে। ভাষা আন্দোলনের মতো ইতিহাস পৃথিবীর বুকে বাঙালিরাই সৃষ্টি করেছে। সিডনির জাঁকজমক জৌলুস ও আবর্জনাহীন পরিবেশ নিয়মে বাঁধা সহজ জীবন, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, যানজটমুক্ত পরিবেশ ছোট শিশুটির মন কেড়ে নিতে পারেনি। তিনি এসব কিছুর চেয়ে বাংলাদেশকে ভালোবেসেছে। সে কান পেতে শুনেছে বাংলা মায়ের স্নেহভরা কণ্ঠ আর চোখ ভরে দেখেছে সবুজের সমারোহ, সোনালী ধানের ক্ষেত। ঋক বাংলাদেশের ভালোবাসার প্রতীক।
দেশের অবস্থা আগের মতো নেই কিন্তু তরুণদের বিদেশে যাওয়া কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। আমরা কি তাদের মেধা দেশে কাজে লাগানোর কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছি? এখনো শিক্ষার্থী-তরুণদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চাকরি, বিসিএস আর বিদেশে যাওয়া। কে আইইএলটিএস দিয়েছে, কার স্কোর কতো, কোন দেশে যেতে কতো স্কোর লাগে, ফুল স্কলারপিশ পেতে কতো স্কোর লাগে, কার ক্লাস কবে শুরু, ইউরোপ, আমেরিকা না অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা ভালো ইত্যাদি। তাদের বিদেশে যাওয়ার এই ইচ্ছে মানে বিদেশেই থেকে যাওয়ার বাসনা প্রায় সবারই মনে। এই প্রবণতাকে কি আমরা নেতিবাচক বলতে পারি? অবশ্যই না। বিশেষ করে বর্তমানকালে কিন্তু শুধুমাত্র বড় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা বড় আমলাদের ছেলে-মেয়েরা নয়, আপামর শিক্ষার্থীরা কিন্তু এখন বিদেশে যাচ্ছে, যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, কানাডা, অষ্টেলিয়া আর মালয়েশিয়া ও ভারতে তো যাচ্ছেনই। তারা কিন্ত ধার দেনা করে বিদেশে যাচ্ছেন। আশা কোনো একটা কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানো কিংবা টিচিং অ্যাসিসটেন্টশিপ পেয়ে পড়ার খরচ চালাবে এবং বিদেশে টিকে থাকবে। তাদের কেউ কেউ বলে, তারা যেখানে গেছে সে দেশে বা শহরে একটা ‘লাইফ’ আছে। লেখাপড়া, আড্ডা, কাজ, বেড়ানো সবই চলছে। তবে, দেশের বায়ুদূষণ, রাজনৈতিক দূষণ, অনিশ্চয়তা এগুলো থেকে তারা ভালো আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একটি ছাত্র সংগঠনের কথায় উঠবস করা, হাতে হকিস্টিক নেয়া, এগুলো থেকে তারা মুক্ত।গভীর রাতে তাদের হাতে হেনস্তা হওয়া, তাদের সঙ্গে মিছিলে যাওয়া, মিছিলে না গেলে মার খাওয়া এসব থেকে তারা বেঁচে গেছেন।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যারা মেধাবী তারা যদি এভাবে শয়ে শয়ে দেশ ছাড়তে থাকেন, তাহলে দেশটাকে কারা এগিয়ে নেবে? ভবিষ্যতে কারা নেতৃত্ব দেবে? ঠেকার কাজ চালানোর মতো লোক দিয়ে একটি দেশ কীভাবে সামনের দিনগুলোতে কঠিন, কঠোর প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে? দেশ এগিয়েছে অনেক, আবার কোথাও কোথাও পিছিয়েছেও অনেক। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে কিন্তু অভাব কাটেনি, গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু দুশ্চিন্তা দূর হয়নি। এসব ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে আগালেও মেধাবী তরুণদের বিদেশগামী মনোভাব আটকানোর জন্য কিছুই করা হয়নি। পড়াশোনা করলেও যে ঠিকভাবে একটি কাজ জুটবে তার নিশ্চয়তা নেই। কলুষিত শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন, হকিষ্টিক, রামদা, চাপাতি, পিস্তল নিয়ে ধাওয়া করা, সাধারণ শিক্ষার্থী, ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, রক্তাক্ত করা, মেরে ফেলা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো থেকে বাঁচতে যখন সবধরনের তরুণদের প্রচেষ্টা থাকে দেশের বাইরে যাওয়ার তখন আমরা তাদের কি দোষারোপ করতে পারি?
অর্থ আয়ই সবসময় উন্নত জীবনযাপন বা ভালো থাকার একমাত্র নির্ণায়ক হয় না। সরকারি সেবা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, মর্যাদা অনেক কিছুই এর সঙ্গে যুক্ত। আমরা যদি আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ করতে পারতাম, পড়াশুনার পরিবেশ তৈরি করতে পারতাম এবং সঠিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারতাম তাহলে দেশ থেকে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে পড়াশোনার জন্য বিদেশে যেতেন না, দেশ থেকে কোটি কোটি ডলার বিদেশে যেতো না। সেগুলো দেশের কাজে লাগতো। আমরা পেতাম চমৎকার পাবলিক বাস, হাসপাতালে চিকিৎসা। কিন্তু এই ছাত্ররাজনীতি সব শেষ করে দিলো। আমরা সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করি, গ্রহণ করি না নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির। শুধু আমাদের দেশের নয় পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে, বিশ্বের বিভিন্ন অনুন্নত দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী এখানে আসতো। আমার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আর একটি হাতিয়ার হতো এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্মুক্ত পরিবেশ, বিশাল খোলামেলা জায়গা আমরা কোনো কাজে লাগাতে পারলাম না। শুধু ক্যাডার বানাচ্ছি হয় রাজনৈতিক ক্যাডার না হয় সরকারি চাকরির ক্যাডার। সৃষ্টি করতে পারিনি কোনো গবেষক, কোনো বিশ্বমানের শিক্ষক, কোনো জাতীয় চিকিৎসক, কোনো বৈজ্ঞানিক যারা দেশ, মানুষ, শিক্ষা এবং মানবসভ্যতাকে বদলে দিতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকজন শিক্ষককে মনে হয় কোনো পার্টির ক্যাডার। আমরা হয় বানাচ্ছি অস্ত্রধারী ক্যাডার, আর না হয় ক্যান্টিনে ফ্রি খাওয়া আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের মাস্তান। আর যারা বই পুস্তক নাড়চাড়া একটু করছে তারা হতে চাচ্ছে সরকারি চাকরির ক্যাডার। কাজেই শিক্ষার্থীরা বিদেশে তো যাবেই।
শিক্ষার্থী হিসেবে বিদেশে যাওয়া, পড়াশুনা শেষে চাকরি ও থেকে যাওয়ার চিন্তার মোক্ষম জায়গাটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা। শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, গোটা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মানুষ সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রতিদিন মেক্সিকোর বর্ডার পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই স্বপ্নের দেশে ঢোকার চেষ্টা করে। এসব দেখে মনে হয় এসব দেশের মানুষ, দেশ ও নীতিনির্ধারকেরা তাদের দেশে মেধাবী তরুণদের ধরে রাখা, তাদের মেধাকে দেশের কাজে লাগানোর কোনো প্রচেষ্টাই করেন না। আর তাই সমুদ্র, পাহাড়, মাঠ-ঘাট ও জঙ্গল পেরিয়ে সবাই ঢুকতে চান আমেরিকায়। আরো কিছু দেশ যেমন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে কিন্তু সবকিছুর শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকায় থাকা এক প্রবাসী আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের এমন কোনো পরিবার নেই যারা কোনো না কোনোভাবে আমিরকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত। শুধু কি শিক্ষার্থীরা, পৃথিবীর সব দেশের রাজনীতিবিদ ও আমলা যারা নিজের দেশে ধিকৃত কিংবা হুমকিতে থাকেন তারা সবাই কিন্তু আশ্রয় নেন আমেরিকায়। আর আমেরিকাও উদারভাবে সবাইকেই আশ্রয় দেয়, সবাইকেই গ্রহণ করে।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক