১.
মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ভারত ও বাংলাদেশের বিচারাঙ্গন নিয়ে দুজন ভিন্ন বক্তার পৃথক বক্তব্য দুই দেশেই ব্যাপক আলোচিত।
৯ নভেম্বর ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দেশটির প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, কোনো বিচারপতির সমালোচনা কখনোই আদালত অবমাননা বলে গণ্য হবে না। বিচার প্রক্রিয়া এবং রায়ের সমালোচনাও নয়। বিচারপতি হিসেবে ২৩ বছর ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে ১ বছর পূর্ণ করা চন্দ্রচূড় আরো বলেন, সাম্প্রতিক অতীতে আদালতের সমালোচনা বেড়ে গেছে। বহু মানুষ সামাজিক মাধ্যমে বিচারপতি এবং বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিচারপতিকে নিশানা করা হচ্ছে। আবার বিচারপতিকে দেবতা জ্ঞান করার প্রবণতাও বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলার শুনানি চলছে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে। তিনি বারে বারে রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
২. বিচারিক আদালতের বিচারক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু গত ১১ নভেম্বর বলেছেন, ‘উচ্চ আদালতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্রিলিয়ান্ট লোকদের বিচারপতি হওয়া, কিন্তু সেখানে সবচেয়ে অযোগ্য লোক বিচারপতি হন। মেট্রিক থার্ড ডিভিশন, ইন্টারমিডিয়েট থার্ড ডিভিশন, বিএ থার্ড ডিভিশন, সেন্ট্রাল ল কলেজে কোনোমতে টাইন্না-টুইন্না নাইটে পাস, সেও বিচারক।’
ঢাকায় আইনজীবীদের অংশগ্রহণে জাতীয় পার্টির এক অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, আমরা ৬৬ জন একযোগে শর্ট বিসিএস দিয়ে সহকারি জজ হয়েছিলাম। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিফথ ব্যাচ ল ডিপার্টমেন্টের, আমার ক্লাসমেট। …আবার অনেক লোক আছেন যারা বাল্বকে বাল্ব লিখতে পারবেন না তারাও বিচারক হয়েছেন।
প্রথমে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত চুন্নুর বক্তব্য এখন ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল।
৩. শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির শেকড় সন্ধান ও অপরাধীর (যেই হোক) শাস্তি (অবৈধ নিয়োগ পাওয়া হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল) বিষয়ে কোলকাতা ও দিল্লির উচ্চ আদালতের কঠোরতার নজির হামেশাই দেখি। আর আশায় বুক বাঁধি আমাদেরও এমন কবে হবে। আশায় থাকার মধ্যেই দেখতে থাকি আমাদের দেশে আদালতের রায়ে হাজার হাজার শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ার অসংখ্য ঘটনা। এর মধ্যে কোনো রায় মানবিক কারণে আবার কোনো রায় আইনজীবীর ল পয়েন্টে কথা বলতে ব্যর্থতা বা উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত আদালতের সামনে হাজির করতে ব্যর্থতার কারণে। অনুকম্পায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সনদ দেয়ার বিধানও আছে। সাধারণত নিয়োগ, পদোন্নতি বা ক্যাডার-নন-ক্যাডার কিংবা মর্যাদার প্রশ্নে প্রচলিত পদ্ধতিতে যারা বাঁধাগ্রস্ত হয়ে নিজেদের সংক্ষুব্ধ ও বঞ্চিতবোধ করেন তাদের মধ্য থেকেই আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়ার নজির বেশি। তথ্য-প্রমাণ হাজির, যাচাই-বাছাই শেষে বিচারপতিরা রায় দেন। রায় বাস্তাবায়নও হয়। আবার বাস্তবায়ন না হওয়ারও নজির আছে। দুই দশকের শিক্ষা সাংবাদিকতায় এমনই ঢের দেখেছি।
৪. বহুদিন ধরে ভাবছিলাম, ‘মাননীয় প্রধান বিচারপতি, শুধু আইন শিক্ষা নয়, জাতির পুরো শিক্ষারই অভিভাবকত্ব গ্রহণ করুন’ শিরোনামে একটা লেখা লিখবো। লেখাটিতে থাকবে কীভাবে বৈধ/অবৈধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ সনদ জোগাড় করে গণটোকাটুকি আর মাস্তানি করে বার কাউন্সিল সনদের পরীক্ষায় উতরে আইনজীবী বনে যাওয়া বন্ধ করেছেন আমাদের উচ্চ আদালত। গত কয়েকবছর ধরে কঠিন প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা উতরে তবেই বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষার সনদ মিলছে। সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিটি সেমিস্টারে আইনের শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। সেই বিধানটা মনে করিয়ে দিয়ে ফি বছর বিজ্ঞপ্তি বা হঁশিয়ারি জারি করে বার কাউন্সিল।
ফলে জাপা নেতা চুন্নুর কন্ঠে উঠে আসা বাস্তব বাণী, ‘টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাস বা এলএলবিতে তৃতীয় বিভাগ, টাইন্ন্যা-টুইন্না নাইটে পাসে আইনজীবী বা বিচারপতি’ হওয়ার পথ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে চিররুদ্ধ হবে। আর হয়তো পড়তে হবে না আইন-আদালতের জটিল বিষয় সহজবোধ্য করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে সব্যসাচী সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের অনুসন্ধানে পাওয়া, ‘১৭ বিচারকের নয়জনেরই এলএলবিতে তৃতীয় শ্রেণী’ [প্রথম আলো ২০১০] এর মতো শিরোনাম।
কিন্তু আইন ব্যতীত অন্যান্য সাধারণ বা কারিগরি শিক্ষার কী হাল? আমি সেই দিকে মাননীয় আদালতের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতেই সেই লেখাটির পরিকল্পনা করছিলাম। লেখাতে উল্লেখ করতে চেয়েছিলাম, মাননীয় প্রধান বিচারপতি, প্রয়োজন থাকুক না থাকুক দেশে যে কোনো স্থানে এখনো চাইলেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ একটা স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও বানাতে পারেন। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই বছরের পর বছর তা চালিয়ে যেতে পারেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা লাভ-লোকসানী উদ্যোগ কি-না সেই প্রশ্ন চেপে রেখে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ চালিয়ে যেতে পারেন। [সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এমপিও, ননএমপিও নির্বিশেষে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক করেছে]। বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এসে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই উচ্চ শিক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাদান করতে পারে। সরকারি কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা পাওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ঠিকাদারি, নোট-গাইড ব্যবসা, আইন ও সংবাদকর্মী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদ-পদবিতে থাকতে পারেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাইলেই স্বায়ত্বশাসনের অপব্যবহার করতে পারেন। একইসময়ে একাধিক লাভজনক পেশাতেও থাকতে পারেন। ৪৯ বছর বয়সেও কেউ একজন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার জীবন শুরু করতে পারেন। চাইলেই ব্যাকডেটে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ দেখিয়ে নিবন্ধন সনদ ছাড়াই হাইস্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে ঘুষ দিয়ে এমপিওভুক্ত হতে পারেন।
চাইলেই এনটিআরসিএকে এড়িয়ে অদক্ষ ও নিম্নমেধার জনবলকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া যায়। যদিও এনটিআরসিএ আইনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগমাত্রই নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। কিন্তু চাইলেই শিক্ষাবোর্ডকে ম্যানেজ করে যে কেউ পাবলিক পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারে। চাইলেই পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বহু বছর পরেও ইচ্ছেমতো নাম ও বয়স সংশোধন করাতে পারে। এমন অসঙ্গতি অগণিত।
৫. বার কাউন্সিল সনদের কঠিন ও কঠোর পরীক্ষার প্রসঙ্গ টেনে আরেকটি বাতির নীচের অন্ধকার চিত্র তুলে ধরি। গত ১০ নভেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি শিরোনাম এমন : ‘পরীক্ষার হলে গাইড, ১৫ আইন শিক্ষার্থী বহিষ্কার’। ঘটনা মোটামুটি এমন: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত সচিব সহযোগী অধ্যাপক যীতেন্দ্রনাথ তরফদার বলেন, আজ এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। ভিক্টোরিয়া কলেজ ডিগ্রি শাখায় বঙ্গবন্ধু ‘ল’ কলেজ ও কুমিল্লা ‘ল’ কলেজের কেন্দ্র। অধিকাংশ পরীক্ষার্থী মোবাইল ফোন নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেছেন। অনেকের সঙ্গে ছিল আইন বিষয়ক বইয়ের বিভিন্ন পাতা, ছেঁড়া টুকরা। কয়েকজন পুরো গাইড নিয়ে পরীক্ষার কক্ষে প্রবেশ করেছেন। পরীক্ষা ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার চারটি টয়লেটে দেখা গেছে বইয়ের পাতা, ছেঁড়া অংশ ও হাতে লেখা চিরকুট।
তিনি আরও বলেন, এ কেন্দ্রে দুটি প্রতিষ্ঠানের ২৯১ জন পরীক্ষার্থীর আসন রয়েছে। আজ ১৮৫ জন পরীক্ষায় উপস্থিত হয়েছে। হাতেনাতে নকলসহ আমরা ১৫ জনকে ধরেছি। যার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ‘ল’ কলেজের চারজন ও কুমিল্লা ‘ল’ কলেজের ১১ জন শিক্ষার্থীকে একবছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। পরীক্ষার হলে যার সঙ্গে যে কাগজ পেয়েছি, তা মূল কাগজের সঙ্গে রেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ ও কেন্দ্র প্রধান প্রফেসর ড. আবু জাফর খান বলেন, ‘পরের পরীক্ষায় আমরা আরও কঠোর হব।’
পাঠক, গাইড বই দেখে স্নাতক পরীক্ষায় উতরে ল গ্রাজুয়েট হয়েই কিন্তু তাদেরকে যেতে হবে বার কাউন্সিলের আইনজীবা তালিকাভুক্তির পরীক্ষায়। উচ্চ আদালতের অভিভাবকদের উদ্যোগে বার কাউন্সিল সনদের পরীক্ষা কঠোর হয়েছে বটে, কিন্তু কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন শিক্ষকদের কি অবস্থা?
শুধু পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হওয়া কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ অধ্যক্ষ এবং কেন্দ্র সচিব দুজনকেই হ্যাটস অফ স্যালুট। তারা দুজনই বিসিএস সাধারণ শিক্ষাক্যাডার সদস্য। অসীম সাহস নিয়ে তারা নকল ঠেকিয়েছেন বটে, কিন্তু বদলিযোগ্য চাকরি, তাদের কপালে সুদূর উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষা সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা ভুরুঙ্গামারী কলেজ কিংবা বঙ্গোপসাগরের নোনাজলে ঘেরা দ্বীপের সন্দীপ সরকারি কলেজ আছে কি-না কে জানে? অথবা পরের বছর হয়তো ঠিকই কেন্দ্র সরিয়ে এমন কোনো এমপিওভুক্ত কলেজে নেয়া হবে, যেখানে অবাধে নকল করা যাবে।
৬. কয়েকমাস আগের কথা। শিক্ষক নিয়োগ : মামলায় না মেধায়- এমন শিরোনামেও একটা লেখার তথ্য-উপাত্ত খুঁজছিলাম। এমন সময় একজন নারী কিছু কাগজ নিয়ে আমার দপ্তরে এসেছেন। একজন সহকর্মী জানালেন, একজন আইনজীবী এসেছেন। আর একই সময়ে আরেক সহকর্মী জানালেন, একজন হবু শিক্ষক আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। ব্যক্তি একই। তিনি আমাদের কাছে এসেছেন উচ্চ আদালতের একটা রায় নিয়ে। ইংরেজিতে লেখা রায়টি রিটকারী শিক্ষকদের পক্ষে না বিপক্ষে, নাকি কোনোটিই না এটাই তিনি জানতে চান। নারী হবু শিক্ষক জানালেন, তাদের আইনজীবী তাদেরকে বলেছেন, রায়টি তাদের [শিক্ষকদের] পক্ষে। অর্থাৎ এখন এনটিআরসিএ তাদেরকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য। আর এনটিআরসিএ বলেছে, রায়টি পক্ষে নয়। সুতরাং তারা নিয়োগ পাবেন না। এ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন তিনি। বললাম, তাহলে আপনি একটা ভিডিও বা অডিও ইন্টারভিউ দেন আমাদেরকে। আমরা সেটা প্রচার করে দেই। কিন্তু তিনি তা করতে চাননি। কারণ হিসেবে অস্ফুটে জানালেন, ‘সামনে আমার বারে তালিকাভুক্তির বিষয় আছে, আমার মতামত যদি বিচারপতি বা আমার আইনজীবীর বিপক্ষে যায় তাহলে ক্ষতি হবে।’ পয়ত্রিশোর্ধ সেই নারীর কাছে জানতে চাইলাম, তাহলে রিট করে শিক্ষক হতে না পারলে আইনজীবী হবেন? তিনি হ্যাঁ সুচক জবাব দিলেন। কোথাও শিক্ষকতা করছেন প্রশ্নে চুপ থেকে বললেন, ‘শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে আদালতে দৌড়াচ্ছি, যদি শিক্ষক হতে পারি তাহলে আর আইনজীবীর দিকে যাবো না’।
৭. আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তি নিয়ে [প্রথম আলোতে নিবন্ধ লেখার দায়ে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা] পরপারে যাওয়া মিজানুর রহমান খানের প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। ওই লেখায় যে বিচারপতির প্রসঙ্গ ছিলো তিনিই স্বতপ্রণোদিত হয়ে নিজের বেঞ্চেই শাস্তিটা দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে জনাব খান ভারতীয় প্রধান বিচারপতির ‘আদালত অবমাননা’ সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়ে একাধিক লেখা লিখতেন হয়তো। বিচারপতিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে জাপা নেতা চুন্নুর ‘শব্দবোমাও’ লেখার বিষয় হতো হয়তো।
আজ থেকে প্রায় ২৯ বছর আগে জনাব খানের বয়স ছিলো ২৭ বছর। প্রথম আলো পত্রিকা প্রকাশেরও কয়েকবছর আগে ‘সংবিধান ও তত্ত্বাবধয়ক সরকার বিতর্ক’ গ্রন্থ লিখে দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছিলেন খান। গত দুই যুগে তার বিভিন্ন লেখায় একাধিকবার উঠে আসা ভবঘুরে ও সংসারবিবাগী আবু সাফা এবং বরগুনার বেতাগীর শিক্ষক মালেক কর্তৃক জমির অধিকারবঞ্চিত চন্দ্রভানুর সুপ্রিম কোর্টে আসার কথা আপনাদের মনে আছে হয়তো।
প্রধানমন্ত্রীর পদ তখন বর্তমানে নিজ বাসায় থাকা বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অলংকৃত করে আছেন। তিনি কিংবা তাঁর মিত্ররা চাননি যে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্যসহ আটটি তথ্য প্রকাশ করা হোক। কিন্তু আদালত তো রায় দিয়েছিলো যে প্রার্থীদের আটটি তথ্য দিতে হবে। তাই নেপথ্যের কুশীলবেরা কলকাঠি নাড়লেন, তাঁদের আবিষ্কার হলেন আবু সাফা। তথ্য প্রকাশের বিপক্ষে ‘জনস্বার্থে’ দায়ের করা সাফার লিভ টু আপিল তেলেসমাতি ঘটিয়ে ফেলেছিলো। কতশত লিভ টু আপিল পড়ে থাকে, কিন্তু এই সংসারবিবাগি ভবঘুরের দায়ের করা লিভ টু আপিলের মাহাত্ম্য ছিল অবাক করা। শেষতক সু্প্রিম কোর্টের নির্দেশে শিক্ষাসহ নানা তথ্য দেয়া বাধ্যতামূলক হয়। হেরে যান আবু সাফারা।
আর চন্দ্রভানুর কথা বলার কারণ ব্যাখ্যা করি। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন চন্দ্রভানু এমন কাউকে খুঁজছিলেন যিনি তার প্রতিপক্ষ শিক্ষক মালেককে ঘায়েল করতে পারেন। এক যুগেরও বেশি সময় আগে বরগুনা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর হয়ে ঘুরতে ঘুরতে তিনি সুপ্রিম কোর্টে হাজির। চন্দ্রভানুর ধারণা, মালেকের অফিসের চাইতে এটা বড় অফিস। তাই প্রতিপক্ষ সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষক মালেককে পরাজিত করার অফিস এটাই। পুটঁলি হাতে বিড়বিড় করা চন্দ্রভানু নজরে পড়েন জনাব খানের। শিরোনাম হয়, সুপ্রিম কোর্টে চন্দ্রভানু, পাকাধানের স্থিতাবস্থা ইত্যাদি। এসব লেখার ফলে উচ্চ আদালতের নজরে আসে চন্দ্রভানুর বঞ্চনার ঘটনা।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের প্রিয় আইন-আদালত লেখক প্রয়াত মিজানুর রহমান খানের সহোদর আমি। আজ থেকে ১৩ বছর আগে যখন ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের শিক্ষা ও সংসদ বিষয়ক রিপোর্টার, তখন আজকের সারাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জনপ্রিয় শিক্ষা বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম (dainikshiksha.com) চালু করি। তখন থেকেই জনাব খান বলে আসছিলেন এর চেয়ে জরুরি আইন-আদালত নিয়ে একটা কিছু করার। তিনি বারবার আমাকে মনে করিয়ে দিতেন, বিচারব্যবস্থা আদিম মানুষের সভ্য হওয়ার প্রথম পথ। আর তাই জনাব খানের ধ্যান-জ্ঞান ছিলো আইন-আদালত ঠিক থাকলে একটা দেশের সব ঠিক থাকে। শিক্ষাটা মেরুদণ্ড, তাই ওটা আগে ঠিক করা জরুরি। তারও আগে জরুরি নৈতিক ও মানসিকভাবে সৎ মানুষদের খুঁজে খুঁজে বেশি বেতন দিয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া।
সুপ্রিমকোর্টের হস্তক্ষেপে যখন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীর আসন সংখ্যা ঠিক করে দেয়া এবং দারুল ইহসানসহ সব আাইন সনদ বিক্রির দোকান বন্ধ, কঠোর বারের সনদ পরীক্ষা শুরু হয়, তখন আমি আপনাদের প্রিয় খানকে আবারও মনে করিয়ে দিলাম, শিক্ষাটা আগে ঠিক করা জরুরি। আমি বলেছিলাম, চলুন একটা রিট করি। তারপর দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তার প্রধান সম্পাদক এবং ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এর সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দিলে আমি মাননীয় বিচারপতিদের সামনে সব যুক্তি তুলে ধরবো। সেই রিট করা হয়নি। আদালত অবমাননার শাস্তি নিয়ে প্রায় তিন বছর আগে পরলোকে যাওয়া জনাব খানের ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিচারক নিয়োগ নিয়ে লেখা একটা নিবন্ধের শিরোনাম ‘সুপ্রিম কোর্টকেই নেতৃত্ব দিতে হবে’ মনে করিয়ে দিয়ে লেখাটা শেষ করলাম।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও সম্পাদক এবং প্রকাশক, দৈনিক শিক্ষাডটকম।
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার চ্যানেলের সাথেই থাকুন।ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।