বিয়ের আগেই যৌতুক নিয়েছিলেন ১০ লাখ টাকা। বিয়ের পর দাবি করেন আরও ৫০ লাখ। দিতে না পারার কারণে স্ত্রীর ওপর চালাতেন নির্মম নির্যাতন। এসব অভিযোগে মামলা হওয়ায় সেই সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রুবেল হককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের শৃঙ্খলা-২ শাখার জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে রুবেল হককে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে আদেশের কপি গত সোমবার পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জ কার্যালয়ে এসে পৌঁছেছে। তবে গতকাল বুধবার সকালে ফোন করা হলে তখন একটি প্রশিক্ষণে আছেন বলে জানিয়েছেন রুবেল হক।
রুবেলের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। নওগাঁর মেয়ে সায়মা সুলতানার সঙ্গে ২০২১ সালের ৩১ মে তাঁর বিয়ে হয়। তার পর থেকে ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করতে থাকেন। এ জন্য কয়েক দফা নির্যাতন চালান স্ত্রীর ওপর। সে সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্যাতনের কথা জানান সায়মা। কিন্তু নির্যাতন চলতে থাকে। নির্যাতনের মুখে সায়মা থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। পরেরবার নির্যাতনে ৯৯৯-এ ফোন করেন সায়মা। বাড়িতে পুলিশ যায়। কিন্তু পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে বলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে সায়মা আদালতে
মামলা করেন। সায়মার আবেদনে এ মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়।
টাঙ্গাইলের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রূপন কুমার দাশ ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, রুবেল হক ৩৬তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশে যোগ দেন। চাকরি পাওয়ার আগে থেকেই সায়মার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর থেকেই রুবেল নারায়ণগঞ্জে তাঁর সরকারি কোয়ার্টারে বন্ধুদের নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার মদের আসর বসাতেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, থানায় জব্দ করা মদ নিয়েই আসর বসাতেন তিনি। স্ত্রী সায়মা কিছু বললেই তাঁকে চড়-থাপ্পড় মারতেন। এ কোয়ার্টারেই রুবেলের বাবা-মা থাকতেন। সায়মা তাদের কাছে অভিযোগ করলে তারা বলতেন, ‘এসপি এ রকম বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা-ড্রিংকস করতেই পারে।’ তারপরও কিছু বললে তাঁরা সায়মাকে ‘ফকিন্নির বাচ্চা’ বলে গালি দিতেন। নারায়ণগঞ্জে একাধিকবার নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সায়মা।
যোগাযোগ করা হলে সায়মা জানান, বিয়ের আগেই খরচ হিসেবে ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন রুবেলের বাবা। তবে তাঁরা ব্যাংকের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। প্রমাণ রেখে টাকা দেওয়ায় ভীষণ চটেছিল রুবেলের পরিবার।
পরে বিয়ের দিন আরও ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বিয়ের উপহার, অন্যান্য খরচসহ খরচ হয় আরও ৯ লাখ টাকা। তারপরও রুবেলের দাবি কমেনি। বিয়ের পর একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য ৫০ লাখ টাকা দাবি করে আসছিলেন। দিতে না পারার কারণে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি আদালতে মামলা করেন।সায়মা আরও জানান, তিনি এখন আলাদা থাকেন। তবে তাঁদের এখনো ডিভোর্স হয়নি। গত বছরের ২৯ আগস্ট তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। আদালতে মামলা করেন ৬ সেপ্টেম্বর। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর রুবেলও তাঁর বাবাকে দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে একটি মামলা করান। এতে সায়মাসহ তাঁর পরিবারের পাঁচজনের বিরুদ্ধে উল্টো ৫০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় সমন জারি করেন আদালত। ২৯ সেপ্টেম্বর সায়মা আদালতে হাজির হলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি কারাভোগ করেন। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। সায়মার মামলা তুলে নেওয়ার জন্য পাল্টা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তর সায়মার অভিযোগ তদন্ত করেছে। এ ছাড়া রুবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টিও জেনেছে। তাই তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারপরও বুধবার প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন বরখাস্ত হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা রুবেল।
বুধবার সকালে ফোন করা হলে রুবেল হক নিজেই বিষয়টি জানিয়েছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলার কারণ জানতে চান। স্ত্রী নির্যাতন ও বরখাস্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কথা বলব না। এখন প্রশিক্ষণে আছি।’
বরখাস্ত হওয়ার পরও রুবেল প্রশিক্ষণে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেন বলেন, ‘রুবেল কী বলেছেন সেটা জানি না। তাঁর বরখাস্তের প্রজ্ঞাপনটি গত সোমবার পেয়েছি। সরকার যখন বরখাস্তের অর্ডার জারি করে, তখন থেকেই এটা কার্যকর।’