দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো আর ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে ফেরার ১১ বছর পরও সেই স্মৃতি স্মরণ করে কাঁদলেন সাভারের রানা প্লাজার বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।
তপ্ত রোদে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন রানা প্লাজা ধসের স্মৃতি আর স্বজন হারানোর কথা বলছিলেন, চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি কেউ।
স্বজন হারানোর বেদনা আর পঙ্গুত্ব নিয়ে হাহাকার জীবনের আর্তনাদই কেবল শোনা যাচ্ছিল জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে।
মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করে চিকিৎসার ব্যয়ে যারা সর্বস্বান্ত, সেই পোশাক শ্রমিকরা বুধবার প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েছিলেন মানববন্ধনে।
শ্রমিকরা বলছিলেন, রানা প্লাজা ধসের পর থেকে প্রতি বছরই তারা এমন মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে আসছেন। কিন্তু এখনো তারা প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ পাননি। সেইসঙ্গে ১১ বছরেও মামলার বিচার শেষ হয়নি। কিন্তু দীর্ঘ এই সময় ধরেই স্বজন হারিয়ে, পঙ্গুত্ব নিয়ে অর্থাভাবে অনাহারে তাদের দিন কাটছে।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আটতলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরো হাজারখানেক তৈরি পোশাক শ্রমিককে।
গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়া সেই ঘটনার ভুক্তভোগী শ্রমিক আকলিমা বুধবার মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।
আকলিমা বলছিলেন, “ভবন ধসের পর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ছিলাম। দুর্ঘটনার এত বছর পরও আমি কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। অথচ আমাদের ঘামে কত পোশাক বিদেশে যায়, অনেক বিদেশিরা আমাদের প্রশংসা করে। কিন্তু আমার পরিবার থাকে অনহারে।”
দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দাবি করার পাশাপাশি মামলার আসামি সোহেল রানাসহ ও অন্যদের দ্রুত বিচার দাবি করেন তিনি।
রানা প্লাজা ধসে ভাই হারানো সোনিয়া মানববন্ধনে বলেন, “যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ছিল তা পাইনি। প্রথমদিকে কিছু পয়সা-কড়ি দিয়েছে, এরপর আর খোঁজখবর নাই।
“আমি এখন আরেকটা গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করি। আমার ভাইয়ের পাওনার জন্য অনেক মানববন্ধন করেছি। এরকম রোদে থেকে অনেকের সঙ্গে মিছিল করেছি। কোনো ক্ষতিপূরণ আসেনি। আমরা কি এইভাবে ক্ষতিপূরণ না পেয়ে খালি কান্না করে যাব? আপনারা কেউ কি আমাদের দিকে তাকাবেন না?”
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দুই হাত হারান সোহরাব। প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধনে তার মা মনোয়ারা বেগম বলছিলেন, “আমার ছেলের দুইটা হাতই নাই। পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে আমি এখনো কতজনের কাছে যাই আমার ছেলের পাওনা টাকাগুলোর জন্য।
“শুনছি সরকার ব্যবস্থা করছে, কিন্তু আমাদের কাছে তো টাকা আসেনি।”
রানা প্লাজা ধসে নিহতদের স্বজন ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের মানববন্ধনে হাজির হয়ে নিজেদের দুর্দশার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ‘রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যার ১১ বছর’ লেখা ব্যানার নিয়ে হাজির হন। কারো কারো হাতে ছিল ‘রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডে রানাসহ সকলের নজিরবিহীন শাস্তি চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর রানা প্লাজা ভিকটিমস’, ‘এনসিওর রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড জব ফর রানা প্লাজা ভিকটিমস’ লেখা প্ল্যাকার্ড।
সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, “আপনারা এখানে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কান্নার কথা, বেদনার কথা শুনেছেন। আমরা আর কত শ্রমিকদের লাশ হতে দেখব শুধু মালিক ও সরকারের অবহেলা আর অতি মুনাফার কারণে।
“শ্রমিকদেরকে আর মুনাফা তৈরির যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক ফয়দা লোটা যাবে না। শ্রমিকদের তার যোগ্য মর্যাদা না দিলে আর এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের এই শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।”
নাজমা বলেন, “রানা প্লাজার ১১ বছর পূর্তির দিনই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে ‘কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডাইরেক্টিভ’ এর ভোটের ওপর অধিবেশন রয়েছে। আমি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিক ও রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সকল সদস্যকে আহ্বান জানাই, তারা যেন ‘কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডাইরেক্টিভ’-কে ভোট দেয়। কারণ এই আইন নিশ্চিত হলে সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি স্তরে ন্যাযতা নিশ্চিত হবে।”
মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে শ্রমিক নেত্রী খাদিজা আক্তার, মমতাজ বেগম, উর্মি আক্তার, হালিমা বেগম ও বিলকিছ বেগমসহ অনেকেই কথা বলেন।
শ্রমিকদের দাবি
প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধন থেকে কয়েকটি দফা দাবি তুলে ধরেন গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা।
দাবিগুলো হল- রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ সকল আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান; আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা কর্মসংস্থান ও পুর্নবাসন; নিহত-আহত শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়ার সু-ব্যবস্থা করা; সকল ক্রেতা ও ব্র্যান্ডকে একর্ড চুক্তি স্বাক্ষর করা; ইপিজেডসহ সকল কারখানায় অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন ও যৌথ দরকষাকষির স্বাধীনতা; শ্রমিকদের সামজিক সুরক্ষা ও তাদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা।
এছাড়া শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত কারণে বীমার আওতায় আনা; মাতৃকালীন ছুটি ছয় মাস নির্ধারণ; কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন ও আইএলও’র সনদ ১৯০ অনুস্বাক্ষর করা এবং কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডাইরেকটিভে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের সকল সদস্যদের ভোট দেয়ার আহ্বান।