আমাদের বার্তা ডেস্ক: মার্কসীয় তাত্ত্বিক ও ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা রেবতীমোহন বর্মণ এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হরমোহন বর্মণ ছিলেন রায়বাহাদুর খেতাবপ্রাপ্ত একজন আইনজীবী। মা রুক্সিণী দেবী। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি সেন্টপলস কলেজ থেকে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ এবং ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ পাস করেন ও জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
১৯২৩-১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে রেবতীমোহন বর্মণ বেঙ্গল-ভলান্টিয়ারের কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রুপের নেতৃত্ব দেন এবং শ্রীসংঘে যুক্ত থেকে কাজ করেন কলকাতা, বাঁকুড়া এবং বীরভূমে। ১৯২৭-১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্র-যুব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া স্বর্ণপদক বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকায় নিজের সম্পাদনায় বেণু নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। বেণুর প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের একটি গান প্রকাশিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস বিপ্রদাস-ও প্রকাশিত হয় বেণু পত্রিকায়।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে কলকাতায় পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের ওপর বিপ্লবীদের আক্রমণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রেবতীমোহনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বিনা বিচারে আটককালে তাকে বিভিন্ন জেলখানায় স্থানান্তর করা হয়। জেলে বসে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদী দর্শন ও আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। দেউলী জেলে অবস্থানকালে অন্যান্য বিপ্লবীদের নিয়ে রেবতীমোহন বর্মণ প্রকাশ করেন The Communist ও সংহতি। জেলখানায় তিনি পাঠচক্রের মাধ্যমে বন্দিদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ওপর দীক্ষা দিতেন। দীর্ঘ আট বছর কারা-শাস্তির পর রাজপুতনার দেউলী জেল থেকে তিনি ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই মুক্তি পান। এরপর তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে সম্পৃক্ত হন এবং সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্টির দায়িত্ব নিয়ে শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে স্যার এফ ফ্লাউডের নেতৃত্বে গঠিত Land Revenue Commission-এর কাছে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ বঙ্গীয় কিষাণ সভার পক্ষে মৌখিক সাক্ষ্য দিয়েছিলেন রেবতীমোহন বর্মণ। কমিশন বরাবরে পেশকৃত বাষট্টি পৃষ্ঠার স্মারকলিপিটি প্রণয়ণেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মার্কসবাদ প্রচারের উদ্দেশে লেখালেখি এবং প্রকাশনার উদ্দেশ্যে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কমরেড মুজাফফর আহমদ এবং অন্যান্যের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন সোসালিস্ট প্রকাশনী সংস্থা ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’। একই সময়ে বন্ধুদের সহায়তায় তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘গণ-সাহিত্যচক্র’। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গ্রন্থ ‘তরুণ রুশ’। এছাড়াও তার রচিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, মার্কস প্রবেশিকা, কৃষক ও জমিদার, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্কট, হেগেল ও মার্কস, ভারতের কৃষকের সংগ্রাম ও আন্দোলন, লেনিন ও বলশেভিক পার্টি, অর্থনীতির গোড়ার কথা, সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি অসুস্থ হয়ে নিজ গ্রাম শিমুলকান্দিতে ফিরে যান। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের ফলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মর্মাহত হয়ে তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মভূমি ছেড়ে আগরতলায় আশ্রয় নেন। সেখানেই ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তার মৃত্যু হয়।