রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একটা চলমান গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীণ চলমান সংকটে রোহিঙ্গা সমস্যার গুরুত্ব যাতে কমে না যায় সেজন্য আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। যুদ্ধ ও নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি এর আবেদনও কিছুটা কমে গিয়েছে। এর ফলে সমস্যা সমাধান দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি ও তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকটকেও অন্যান্য সব সমস্যার মতো গুরুত্ব দিয়ে এর সমাধানে তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু টাউনশিপে আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কারণে টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আগস্ট মাসে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নিহত হয়। চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গাদেরকে মংডুর থেকে তাড়িয়ে দেয়ার কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার জন্য নাফ নদীর তীরে অপেক্ষাকালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে। নাফ নদীর পাড়ে এএ’র ড্রোন হামলায় আরো অনেকে আহত হয়েছেন। এএ এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের সময় ক্রসফায়ারে অনেক রোহিঙ্গা নিহত হচ্ছেন। মিয়ানমারে এএ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় টেকনাফ সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে নৌকায় করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিজিবির সদস্যদের তৎপরতার কারণে তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক এএ’র বিরুদ্ধে মোতায়েন করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন এএ’র আক্রমণের মুখোমুখি, তারা রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক তিক্ততাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে যাতে তারা তাদের নিজস্ব লক্ষ্য এগিয়ে নিতে পারে। মিয়ানমারে চলমান সংঘর্ষের কারণে রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরতলী থেকে গত ১৪ আগস্ট মিয়ানমারের ১৩ জন বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২৩ জন বিজিপি সদস্য পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা বিলম্বিত হচ্ছে। আগস্টে মাসের শেষের দিকে তাদেরকে ফেরত পাঠানোর জন্য চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। রাখাইনে সংঘর্ষের কারণে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিজিপি ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শুরু করে। গত এপ্রিল ও ৯ জুন মাসে তিন দফায় ৭৫২ জন পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এই ধারা এখনো চলমান রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত এএ’র নিয়ন্ত্রণে এবং এই সীমান্ত দিয়ে যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ এবং নিরাপত্তার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রায় সাত বছর ধরে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই এই সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান। তবে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা যায়নি। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আত্মীকরণের জন্য তাদের জীবিকার ব্যবস্থা উন্নয়নকল্পে বিনিয়োগ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। চলমান পরিস্থিতিতে এই সংকট নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত প্রহরা জোরদার ও নজরদারি বাড়াতে হবে। সীমান্ত দিয়ে নতুন করে যাতে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য টেকনাফে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল এবং কড়া নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
জনবহুল বাংলাদেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা ও উদ্বেগের কারণগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকরী সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইনে দ্রুত সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন শুরু করা দরকার। রাখাইনে চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করা এবং তাদের জোরপূর্বক মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পরিস্থিতিকে অসহনীয় করে তুলেছে যা কাম্য নয়।
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন এবং তাদের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫৬তম অধিবেশনে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সব সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে পেশ করা হয়। আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি ১০ জুলাই জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে চলমান রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের ওপর জোর দিয়ে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারে যুদ্ধরত সব পক্ষকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেয়া এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। মিয়ানমার সংঘাতের কারণে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশের জানমালের ক্ষয়ক্ষতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারকে তার আন্তর্জাতিক সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত বিমসটেক দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সুই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেয় এবং তার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর অভিপ্রায় পুনর্ব্যক্ত করে। তবে চলমান প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়া কার্যকর করার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
গত সাত বছরে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মাঝে সম্প্রীতি সৃষ্টি ও বিভেদ দূর করতে কোনো সফল উদ্যোগের কথা জানা যায় নেই। মিয়ানমার সরকার এখনো এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ক্রমেই বাড়ছে। একইভাবে রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গারাও ভালো নেই। তাদেরকে এএ এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত বিভাজনের জন্য তাদের উদ্দেশ্য পূরণে সফল হচ্ছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান আরো জটিল ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মিয়ানমার সামরিক সরকারের ৭০ বছরের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা তাদের এই অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করতে দক্ষ। রাখাইন রাজ্যে জান্তা রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্যে করেছিলো। এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে।
মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সহিংসতা বৃদ্ধি, রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক সশস্ত্রবাহিনীতে নিয়োগ এবং রাখাইনে চলমান সংঘাতের কারণে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংস অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য সকল পক্ষকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে ন্যায়বিচার অর্জন এবং রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এএ রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করলেও ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযানের সময় এই সংগঠনটির রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ ছিলো। এএ রাখাইন রাজ্যে বিজয়ী হলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে এএ’র উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে এবং সীমান্তে প্রহরা ও নজরদারি জোরদার করেছে। একইভাবে মিয়ানমার প্রান্তে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি সামাল দিতে এএ’কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। রোহিঙ্গা জাতিসত্তা ও অধিকারের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে এএ, জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) এবং অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের (ইএও) সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে অর্থবহ রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে হবে। চলমান পরিস্থিতিতে বাইরে থেকে ধারাবাহিক চাপ প্রয়োগ চলমান রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, এএ ও এনইউজি নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আসবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক