বাংলাদেশ মানবিক কারণে মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে প্রায় ছয় বছর ধরে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। আশ্রয় এবং সার্বিক সহযোগিতা দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রথম থেকেই মিয়ানমার, চীন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিয়ে সমস্যা সমাধানে নানাবিধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার এগিয়ে না আসার কারণে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম এখনও সফলতার মুখ দেখছে না। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ চুক্তি হয়, সেই চুক্তি মোতাবেক ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে এক দফা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আবারও প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা হয়, তবে তাও সফল হতে পরেনি। গত প্রায় ছয় বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি, ফলাফল শুণ্য। প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনায় চীনের সম্পৃক্ততার পর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ছোট পরিসরে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয় এবং এ বিষয়ে চীন মিয়ানমারকে অল্প-বিস্তর চাপ দিয়ে এসেছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদ্যোগী হয়ে মিয়ানমার সেদেশে নিযুক্ত ৮ দেশের ১১ জন কূটনীতিককে মিয়ানমারের মংডু ও সিটওয়ে শহরে অর্ন্তবর্তীকালীন ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকা সরেজমিনে দেখাতে নিয়ে যায়। মিয়ানমার হাজার খানেক রোহিঙ্গা নেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে, তবে এই প্রক্রিয়ায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনেক সময় লাগবে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে এই দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানের ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তার মোকাবেলায় কক্সবাজার থেকে আরও রোহিঙ্গা স্থানান্তর জরুরী হয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গারা বর্তমানে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে ও মানবেতর জীবনযাপন করার কারণে সেখানে সামাজিক ও নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিরোধ, মারামারি, অপহরণ, পাচার ও জিম্মি করার ঘটনা ঘটছে। অনেক রোহিঙ্গা বিভিন্ন ধরনের মাদক ও অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে এবং এসব ঘটনায় একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে রেখেছে। গুলি করে কিংবা কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পাশাপাশি ক্যাম্পে নাশকতামূলক আগুন লাগানোর ঘটনাও ঘটছে।
বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), দুইটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং সাতটি ডাকাত দলসহ ১০টি দুর্বৃত্ত দল সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে আরসা বেশিরভাগ ক্যাম্প নিয়ন্ত্রন করছে। আরসার উপস্থিতি ও সন্দেহজনক কার্যক্রম ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে। গত ৫ মার্চ বালুখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লেগে প্রায় ২ হাজার ঘর পুড়ে যাওয়ার ফলে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো এবং ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় আগুন দ্রুত পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পগুলোতে ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষয়ক্ষতি বেশী হয়েছে। আরসা সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে এই আগুন দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে গঠিত তদন্ত কমিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত নাশকতা বলে প্রমান পেয়েছে। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তার করতে বা এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো ঘটনার কারনে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা, নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোসহ ১০টি সুপারিশ করে।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ১১ জন প্রাণ হারায়, প্রায় পাঁচ’শ আহত ও ৯ হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যায়। তথ্য মতে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত, ৬০টি নাশকতামূলক, বাকী ৬৩’র কোনো কারণ জানা যায়নি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাতের বেলায় সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের আতংকে রাত কাটে। ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ছয় বছর ধরে স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবিক সেবায় দেশ-বিদেশের শতাধিক সংস্থার ২০ হাজারের ও বেশি কর্মী কাজ করছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হওয়ার কারনে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি ক্যাম্পে কাজ করতে যাওয়া এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরাও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন এবং তাঁদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অপহরণ, খুন ও আরসাসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে ২০টির বেশি এনজিও ক্যাম্পগুলোতে তাঁদের সেবা কার্যক্রম সীমিত রেখেছে এবং কয়েকটি এনজিও তাদের কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় কৃষকদের অপহরণ করে দুর্গম জায়গায় নিয়ে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় জনগণও আতঙ্কে রয়েছেন। দ্রুত এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে জননিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কারনে সাধারণ রোহিঙ্গা, স্থানীয় অধিবাসী, ক্যাম্পে কর্মরত দেশী বিদেশি এনজিও-আইএনজি কর্মী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এতে ক্যাম্পের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবসময় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ১০ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বালি প্রসেস ফোরামের মানবপাচার ও চোরাচালান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং সমস্যা সমাধানে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসনে সব দেশকে সক্রিয়ভাবে কাজ করার আহ্বান জানায়। প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতা কামনা করে বাংলাদেশ। মানবিক সাহায্যের পাশাপাশি শরণার্থী ভিসার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অস্ট্রেলিয়া নেয়ার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ করা হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোকে যুক্ত করতে এবং এ বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে ইন্দোনেশিয়ার সহযোগিতা চাওয়া হয়।
চলমান প্রেক্ষাপটে দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় এবং কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর ক্রমঅবনতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও বেশী রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করতে আগ্রহী। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জীবিকার ব্যবস্থা রয়েছে এবং সেখানে তারা বসবাসযোগ্য পরিবেশে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারবে। ১৭ ফেব্রুয়ারি জাপান, চীন, ফ্রান্স ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতসহ ১৬ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর পরিদর্শন করে সেখানে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রা ও সুযোগ সুবিধা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে।
মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম’ বিষয়ক সভায় সরকার রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরে বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তার আহ্বান জানিয়ে দুটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রথম প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার খরচ বহন এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আরও নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ নিজ ব্যবস্থাপনায় ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আবাসন তৈরি করেছে এবং কক্সবাজার থেকে এপর্যন্ত সেখানে ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছে। আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হবে। এই স্থানান্তর ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের একার পক্ষে এই ব্যয়বহন করা কষ্টসাধ্য। রোহিঙ্গাদেরকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার ব্যয়বহনে সহায়তা করতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরের তিন ভাগের একভাগ জায়গায় ক্যাম্প নির্মাণ করেছে, বাকী দুইভাগ জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ করলে আরও রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা যাবে। ভাসানচরে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বন্ধু দেশগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। দ্রুততম সময়ে যত বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া যাবে ততই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের কারণ উদ্ঘাটন ও মোকাবিলায় জাতিসংঘ মহাসচিব- মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত নোলিন হাইজারকে জোরালো ভূমিকা পালন এবং ‘রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বার্ডেন শেয়ারিং’ নীতির আওতায় জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর কাছে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরার আহ্বান জানান।
বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণে এপিবিএনের সাথে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মিলে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ মোতাবেক বাড়তি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আর্থিক সহায়তার কথা ভাবা হচ্ছে। এসব ভাবনার কার্যকরী পদক্ষেপসহ বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বড় দেশগুলো পাশে এসে দাঁড়াবে- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : বি: জে: (অব:) হাসান মো: শামসুদ্দীন, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক