‘আমার এ ছোট্ট জীবনে এটা ছিল এক ভয়াবহ রাত। আমি আর জীবনে হলে উঠব না। সিনিয়র ভাইদের জন্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেই ভয় করে।’ এভাবেই ভয়ার্ত কণ্ঠে র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের এক নবীন শিক্ষার্থী।
ওই রাতের ঘটনা নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয় ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর।
এদিকে এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযুক্ত সবাই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের অনুসারী বলে জানা গেছে।
বিভীষিকাময় সেই রাতের দৃশ্য তুলে ধরে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে দ্বিতীয় বর্ষের সিনিয়ররা মুজতবা আলী হলের ১১১ নম্বর রুমে আমাদের ডাকেন। আবাসিক তিনটি হলে নতুন ওঠা আমাদের ব্যাচের সবাইকে নিয়ে আসেন তাঁরা।
‘এ ঘটনার এক দিন আগে মুজতবা আলী হলে ১১৭ নম্বর রুমে ছাত্রলীগের একটা গ্রুপে উঠেছিলাম আমি। পরের দিন রাতে ওই রুমে সিনিয়ররা আমাকে ডাকলে প্রথমে যাই নাই। পরে সিনিয়ররা আমাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে গেছেন। ওই রুমে দ্বিতীয় বর্ষের সিআর আসিক হোসেনসহ ১০-১৫ জন ছিলেন। ওই রুমের সামনে সিসি ক্যামেরাও আছে।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘আমার এই ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাতে ভাইয়েরা আমাদের ব্যাচের দুজনকে ধর্ষণের দৃশ্য করতে বাধ্য করেন। এক শিক্ষার্থীকে মেয়ে সাজিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করতে বলেন অপর একজনকে। ধর্ষণের দৃশ্য করানোর পর ওনাদের মনঃপূত না হওয়ায় এক ভাই বলে ওঠেন, তোরা তো ঠিকঠাক একজন আরেকজনকে রেপও করতে পারিস না। এই বলে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। ওই সময়টাতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছিল। এমন দৃশ্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা পরিবেশে পাব, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
‘অন্যদিকে আমার আরেক ব্যাচমেটকে যৌনকর্মী সেজে তাঁর দেহ প্রদর্শন ও খদ্দের ধরার দৃশ্য করতে বাধ্য করেন। দর-কষাকষির মাধ্যমে একজন যৌনকর্মীর দাম কীভাবে ২ হাজার টাকা থেকে ১০০ টাকায় নিয়ে আসা
যায়, ওই দৃশ্যও করান। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি যৌন উত্তেজক গানের যৌন উত্তেজক দৃশ্য করতে বাধ্য করেন আমাদের। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা যেভাবে ট্রেনে টাকা তোলে, সেই দৃশ্যেও অভিনয় করানো হয় অনেকবার।‘এ ছাড়া আমাদের কাছে পরিচয় চেয়ে এটাকে অনেকবার বলান এবং বিভিন্ন শব্দ পরিবর্তন করে আমাদের নামের সাথে যৌনতা সম্পর্কিত শব্দ যোগ করে বলতে বলেন। বলতে অস্বীকৃতি জানালে শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দেন, পাশাপাশি অবিরাম ধমক দিতে থাকেন সিনিয়ররা।
‘আমি সিআর (ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ) হওয়ায় আরও অনেক কিছু ঘটেছে। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেই ভয় করে আমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাইদের জন্য।’
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে একজন কথা বললেও বাকিরা ভয়ে মুখ খুলছেন না। তাঁদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ঘটনার বর্ণনাকারী শিক্ষার্থী।
এর আগে মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়ে গত বুধবার ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বরাবর অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী। ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় র্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বুধবার সকালে ওই ছাত্র অভিযোগ দেন।
অভিযোগ তদন্তে ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. খায়রুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে কমিটির একাধিক সদস্য নিশ্চিত করেছেন।
কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. খায়রুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা কাজ শুরু করেছি। তদন্তের কাজ চলমান।’ এ বিষয়ে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম।