বাউল সাধনার প্রধান গুরু, বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা, গায়ক লালন শাহ ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২) ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে তাঁর জন্মগ্রহণ করেন। মতান্তরে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর ভাঁড়রা গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে তিনি জন্মগ্রণ করেন। এ তথ্যটি পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পরে হিতকরী (১৮৯০) পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ-নিবন্ধে।
কথিত আছে, লালন শাহ যৌবনকালে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন সঙ্গীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। এমতাবস্থায় সিরাজ
লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে সেই জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দু’হাজার গান রচনা করেন। তাঁর গান মরমি ব্যঞ্জনা ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। সহজ-সরল শব্দময় অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী তাঁর গানে মানব জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।
লালন কোনো জাতিভেদ মানতেন না। তাই তিনি গেয়েছেন: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ এরূপ সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিমুক্ত এক সর্বজনীন ভাবরসে সিক্ত বলে লালনের গান বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিকট সমান জনপ্রিয়। তাঁর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ ইত্যাদি গান বাউল তত্ত্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
লালনের গান এক সময় এতোই জনপ্রিয় ছিলো যে, তা সাধারণ মানুষ ও নৌকার মাঝি-মাল্লাদের মুখে মুখে শোনা যেতো। এমনকি বর্তমানেও সকল মহলে এ গানের কদর বাড়ছে এবং রেডিও-টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে। বহু তীর্থভ্রমণ এবং সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গলাভের পর ছেউড়িয়ার আখড়ায় বসেই লালন আজীবন সাধনা ও সঙ্গীতচর্চা করেন। লালনের লেখা গানের কোনো পান্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। সম্ভবত পরবর্তীকালে শিষ্যদের কেউ সেগুলো সংগ্রহ ও সংকলিত করেন।
কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ (১৮৩৩-৯৬) এবং মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) লালন শাহ ও তাঁর গানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। হরিনাথ তাঁর অতি প্রিয় শিষ্য ছিলেন। ছেউড়িয়া থেকে ছয় মাইল দূরে শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ লালন শাহর ২৯৮টি গান সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো থেকে ২০টি গান তিনি প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তিনি মানবধর্ম (Religion of Man) বিষয়ক প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়ও লালনের গানের উল্লেখ করেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭ অক্টোবর, ১৮৯০) ছেউড়িয়ায় লালন পরলোক গমন করেন। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমা (মার্চ-এপ্রিল) ও মৃত্যু বার্ষিকীতে ভক্তবৃন্দ তাঁর মাযারে সমবেত হন এবং তিনদিন ধরে সাধুসেবা ও সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।