বিখ্যাত কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জন্মদিন আজ। তিনি ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে হুগলি জেলার দেবানন্দপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটে ভাগলপুরে মাতুলালয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি দেবানন্দপুরের হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল ও ভাগলপুরের দুর্গাচরণ এম ই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। তারপর টিএন জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাসের পর একই কলেজে এফএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে তার শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে।
অধ্যয়নে বিরতি ঘটার পর শরৎচন্দ্র বনেলি স্টেটে সেটেলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক এবং বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি পদে চাকরি করেন। এক সময় তিনি সন্ন্যাসিদলে যোগ দেন এবং গান ও নাটকে অভিনয় করেন। শরৎচন্দ্র কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘বড়দিদি’ ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যজগতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি একে একে ‘বিন্দুর ছেলে’ ও ‘অন্যান্য’, পরিণীতা, বৈকুণ্ঠের উইল, পল্লীসমাজ, দেবদাস, চরিত্রহীন, নিষ্কৃতি, শ্রীকান্ত (৪ খন্ড), দত্তা, গৃহদাহ, দেনা-পাওনা, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন ইত্যাদি গল্প-উপন্যাস এবং নারীর মূল্য, স্বদেশ ও সাহিত্য প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেনা-পাওনা এবং পথের দাবী খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি বিপ্লববাদীদের প্রতি সমর্থনের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর শরৎচন্দ্র ও ছাত্রসমাজ, ছেলেবেলার গল্প, শুভদা, শেষের পরিচয়, শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলী এবং শরৎচন্দ্রের অপ্রকাশিত রচনাবলী প্রকাশিত হয়।
শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পী। তার উপন্যাসের মূল বিষয় পল্লীর জীবন ও সমাজ। ব্যক্তিমানুষের মন পল্লীর সংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার আঘাতে কতটা রক্তাক্ত হতে পারে, তারই রূপচিত্র এঁকেছেন তিনি তার রচনায়। তবে তার উপন্যাসে ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছা ও মুক্তি সর্বদাই সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় বলে তাকে রক্ষণশীলও বলা হয়ে থাকে। তবে নারীর প্রতি সামাজিক নির্যাতন ও তার সংস্কারবন্দি জীবনের রূপায়ণে তিনি বিপ্লবী লেখক, বিশেষত গ্রামের অবহেলিত ও বঞ্চিত বাঙালি নারীর প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা তুলনাহীন। সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কার ও শাস্ত্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। কাহিনী নির্মাণে অসামান্য কুশলতা এবং অতি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষা তার কথাসাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির প্রধান কারণ। বাংলাসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় তার অনেক উপন্যাসের চিত্রনাট্য নির্মিত হয়েছে এবং সেগুলো অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, যথা: দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি। শরৎচন্দ্র চিত্রাঙ্কনেও দক্ষ ছিলেন। বার্মায় বসবাসকালে তার অঙ্কিত ‘মহাশ্বেতা’ অয়েল পেইন্টিং একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম।
সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য শরৎচন্দ্র কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যপদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেন।