শহীদ শেখ রাসেলের জন্মদিন : বেঁচে থাকলে ৫৯ পেরিয়ে ৬০ বছর - দৈনিকশিক্ষা

শহীদ শেখ রাসেলের জন্মদিন : বেঁচে থাকলে ৫৯ পেরিয়ে ৬০ বছর

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ |

বেঁচে থাকলে ৫৯ পেরিয়ে ৬০ বছরে পা দিতেন তিনি! পুরোদস্তর মধ্য বয়স্ক এক পুরুষের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হতেন। আচ্ছা, দেখতে কেমন হতেন তিনি? সেই গোঁফওয়ালা ভরাট কণ্ঠের রাশভারি চেহারা নাকি আরেকটু ভিন্ন কোন অবয়ব! তা যাই হোক, আদল দেখলে নিশ্চিত বোঝা যেতো, এ আর কেউ নন,  জাতির জনক ছায়া!

হয়তো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে থাকতো, কারণ দেশ পরিচালনা ও রাজনীতির সৎ রক্ত যে তার শরীরে। আবার পিতার প্রিয় বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানীও হতেন হয়তো। কিংবা নিজের ইচ্ছা ছিলো আর্মি অফিসার হওয়ার, তাহলে জাঁদরেল সেনাবাহিনীর জেনারেলেই হতেন সুনিশ্চিত!

স্বপ্নের ভাষায় বলছি, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের কথা। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর হেমন্তের জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাতে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্ম যে শেখ রাসেলের, অনেক অনেক সম্ভাবনার স্বপ্নিল দোলা দিয়ে তিনি চলে গেছেন জীবনের শুরুর দিনগুলোতেই। যদি বেঁচে থাকতেন, হতেন পিতা বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বয়সী। বয়স হতো তার ৬০, বঙ্গবন্ধুর চেয়েও কিছুটা বেশি। কারণ ৫৫ বছরেই প্রাণ দিতে হয়েছিলো পিতা ও জাতির স্থপতিকে। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের এদিনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত দুই বছর থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় লেখক, খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন ‘রাসেল’। এই নামকরণে মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শৈশব থেকেই দুরন্ত প্রাণবন্ত রাসেল ছিলেন পরিবারের সবার অতি আদরের। কিন্তু মাত্র দেড় বছর বয়স থেকেই প্রিয় পিতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের একমাত্র স্থান হয়ে ওঠে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। তবে সাত বছর বয়সে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজেই বন্দি হয়ে যান।

শেখ রাসেলের ভুবন ছিলো তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাতা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালকে ঘিরে। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট কালরাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। তখন রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।

১৯৬৪:- ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতোক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’

সূত্র: শেখ হাসিনা, ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ 

১৯৬৬:- কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তাঁর বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণে তাঁর মন খারাপ থাকতো। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিলো। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’ 

১৯৬৭:- কারগারের রোজনামচায় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪-১৫ এপ্রিলের অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে তুললাম, আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।” রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগলো। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।”

১৯৭১:- ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে রাসেল তাঁর মা ও দুই আপাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। পিতা বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি এবং বড় দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে। মা ও আপাসহ পরিবারের সদস্যরা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর মুক্ত হন। রাসেল ‘জয় বাংলা’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বাইরে তখন চলছে বিজয়-উৎসব।
১৯৭৫:- ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট কালরাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। তখন রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা তাকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তাদের সেই অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধিবোধ সম্পন্ন মানুষদের কাছে পরম আদরের নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকার বঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রাম-গঞ্জ-শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ-লোকালয়ে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। মানবিক চেতনা সম্পন্ন সব মানুষ শেখ রাসেলের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের শোককে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলার প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণের মুখে হাসি ফোটাতে আজ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু ও তার শিশুপুত্র শেখ রাসেলের দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিরা এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে। সেসব দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা আজ সময়ের দাবি।

পরিশেষে বলতে চাই, শেখ রাসেলের জন্মদিনে শুধু দিবস পালনে সীমাবদ্ধ না থেকে শেখ রাসেল যে পরিবারে, যে পরিবেশে বেড়ে উঠতো সেই পরিবারের আদর্শ ও ছোট্ট রাসেলের ছোট্ট জীবনের মানবিক দিকগুলি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে ও তা অনুধাবন, অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করতে পারলেই দিবস পালন সফল হবে। দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৬০তম জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। এ দেশের শিশু-কিশোর, তরুণ প্রজন্মের কাছে শেখ রাসেল এক ভালোবাসার নাম, শেখ রাসেল আজ দেশের আনাচে-কানাচে এক মানবিক সত্ত্বা হিসেবে সবার মাঝে বেঁচে আছেন।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051279067993164