প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ মহান পবিত্র দিন। প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মহামানব বুদ্ধের জীবনসংশ্লিষ্ট কয়েকটি উল্লেখযোগ্য যেসব ঘটনা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত সেগুলোর মধ্যে প্রবারণার গুরুত্ব অনেক বেশি। পালি সাহিত্যে প্রবারণার ব্যাপক অর্থ আমরা দেখতে পাই যেমন- প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা, আশার তৃপ্তি, সন্তুষ্টি, নিমন্ত্রণ, শিষ্টচার, অনুরোধ, ক্ষমা, সংযম, ত্যাগ। তিনমাস বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কৃচ্ছতা সাধনের মধ্যে অধিষ্টানকর্ম শেষ করে একজন অন্যজনকে ক্ষমা প্রদর্শনপূর্বক আপন করে নেয়াই হচ্ছে প্রবারণার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এক কথায় যদি বলি অন্যায় অকুশল কর্মকে বর্জন ও ন্যায় কুশল কর্মকে বরণ করার অর্থ হচ্ছে প্রবারণা।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাসকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বলাহয় বর্ষবাস। বাংলাদেশের বৌদ্ধরা আষাঢ়ী পূর্ণিমাকে বলে ছোট ‘ছাদাং’ আর আশ্বিনী পূর্ণিমাকে বলে বড় ‘ছাদাং’। এই বড় ‘ছাদাং’ হচ্ছে প্রবারণা পূর্ণিমা। ‘ছাদাং’ শব্দটি বার্মিজ শব্দ। বিভিন্ন প্রাপ্ত সূত্রের বরাতে জানা যায়, চট্টগ্রাম এলাকা প্রায় দেড় হাজার বছরের কিছু সময় আরাকান শাসনের অধীনে ছিলো। আরকানীদের আচার ব্যবহার ছিলো বার্মিজ আদলের। সে কারণে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামের মানুষরা তাদের নিয়মনীতি পালনে অভ্যস্থ ছিলো। আমাদের জীবন চলার পথে ‘ছাদাং’ শব্দের মতো এরকম বহু বার্মিজ ভাষা প্রচলিত ছিলো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো আছে। এই ‘ছাদাং’ শব্দটিও ঠিক তাদের কাছ থেকে পাওয়া। সেই থেকে ‘ছাদাং’ নামটি বৌদ্ধদের কাছে অত্যন্ত একটি প্রচলিত শব্দ বলা যায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য বছরের এই তিনমাস সবচেয়ে পূণ্যময় সময়। এই পূর্ণিমায় তথাগত গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন এবং পূজনীয় ভিক্ষুসংঘকে নির্দেশ দিলেন আজ থেকে তোমরা বহুজন হিত, সুখ, কল্যাণে সদ্ধর্ম প্রচার ও প্রসারে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ো। পরদিন থেকে শুরু হয় দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দান। ধর্মপ্রচারের জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নগর থেকে গ্রামে ছুটে যায়।
বর্ষবাসের এই তিনমাস বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ধর্মচর্চা, ধ্যানানুশীন, কৃচ্ছতা সাধন, মানবিক কর্মসাধন, ত্যাগ, ধৈর্য, সহনশীল ও সংযমের মধ্যে দিনযাপন করে থাকে। যদিও বা ভগবান তথাগত গৌতম বুদ্ধ এই নির্দেশ ভিক্ষু সংঘকে উদ্দেশ্য করে প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন। তিনমাস সময় পর্যন্ত ভিক্ষুসংঘরা নিজ নিজ বিহারে অধিষ্টান করা ব্যতীত রাত্রে অন্যকোনো বিহারে রাতযাপন করতে পারবে না। এর একটা ব্যাখ্যা আছে- তৎসময়ে এই তিনমাস ছিলো ঘোর বর্ষাকাল, এখন অবশ্য বৈশ্বিক ভূ-পরিবেশের পট পরিবর্তনের ফলে ঋতুর পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি। যেহেতু বর্ষকাল ছিলো, তথাগত বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে বললেন হে ভিক্ষুগণ, এই সময়ে প্রচুর পরিমাণে নানা জাতের কীট পতঙ্গের বিচরণ ঘটে। বুদ্ধ আরো বললেন, আমাদের চলাচলের ফলে একটি কীট পতঙ্গও যাতে আঘাতপ্রাপ্ত বা বাধার সম্মুখীন না হয়, তাই যথাসম্ভব তোমরা বিহারে থেকে ধর্মচর্চায় রত থাকো এবং কল্যান সাধনে ব্রতী হও। ভিক্ষুদের দেখাদেখি এখন বহু বৌদ্ধ নর-নারীরাও এই তিনমাস সংযম-কৃচ্ছতা সাধনের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় জীবন-যাপন অনুশীলনে রত থাকে। প্রতি অমাবশ্যা, পূর্ণিমা, অষ্টমী তিথিতে অষ্টশীল পালনের মধ্যে উপোসথব্রত পালন করে। এসময় বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকারা নিয়মিত বৌদ্ধধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ, সুত্রপাঠ, ধ্যানানুশীলন, ধর্মশ্রবণ এবং কুশল কর্মপালন এবং মঙ্গল চেতনার মধ্যে দিয়ে পরিস্নাত, পরিশীলিত দিন পালন করেন। মহামানব গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর প্রথমেই সংঘ প্রতিষ্ঠা করার ওপর জোর দেন। সংঘ মানে ভিক্ষু সংঘ। তিনি চিন্তা করলেন হাজার হাজার কোটি কোটি মানুষকে কোনোভাবে তার অর্জিত জ্ঞান প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদি সংঘের মধ্যে দিয়ে কথাগুলো প্রচার করা যায়, সে উদ্দেশ্যে ভিক্ষু সংঘকে প্রথমে একতাবদ্ধ করলেন এবং সর্বক্ষেত্রে ভিক্ষু সংঘকে প্রাধান্য দিয়ে ধর্ম প্রচারে এগিয়ে এসেছিলেন। বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে যে আদেশ দিয়েছিলেন তা আড়াই হাজার পরে এসেও ধর্মচর্চা ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে এটি ছিলো যুগান্তকারী উপদেশ।
এবার আসি বৌদ্ধরা ফানুস বাতি বা আকাশ প্রদীপ কেনো উড়ায়। কথিত আছে, বুদ্ধত্ব লাভ করার পুর্বে সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে সংকল্প করলেন এবং এসময় তার সঙ্গে থাকা সারথী ছন্নকে অশ্ব কন্থক ও শরীরের সমস্ত আবরণাদী তার হাতে তুলে দিয়ে তাকে বিদায় দেন। অতঃপর তিনি ভাবলেন, ‘আমার মস্তকে সুবিন্যস্ত কেশকলাপ প্রব্রজিতের পক্ষে শোভনীয় নহে।’ তিনি দক্ষিণ হস্তে অসি এবং বাম হস্তে রাজমুকুটসহ কেশকলাপ ধারণ করে কেটে উর্ধ্বদিকে নিক্ষেপ করে সত্যক্রিয়া করেছিলেন, ‘যদি সত্যিই আমি ইহজন্মে মহাজ্ঞান (বুদ্ধত্ব) লাভে সমর্থ হই তাহলে এই মুকুটসহ কেশরাশি উর্ধ্বাকাশে উত্থিত হবে।’ তার কেশরাশি আকাশে উত্থিত হলো। তাবতিংশ স্বর্গের দেবগণ কেশরাশি নিয়ে গিয়ে চুলমনি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে লাগলেন। এখবর একান ওকান করতে করতে সমগ্র রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। সেই থেকে কুমার সিদ্ধার্থের কেশরাশিকে পূজা, শ্রদ্ধা, সম্মান করে প্রতিবছর প্রবারণার দিনে বাংলাদেশের মতো সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ফানুস উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে মহামানব গৌতম বুদ্ধের প্রতি অযুত ভক্তি- শ্রদ্ধা-প্রণতি প্রদর্শন করে আসছে। ফানুস মানুষের অন্তর্জগৎকে আলোকিত করার মাধ্যমে সব রকমের পাপ, অন্ধ, কুসস্কার থেকে দূরীভূত হয়ে পবিত্রতা আনয়ন করে। প্রবারণা উৎসবকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ বিহার প্যাগোডা বর্ণিল আলোকসজ্জায় সাজানো হয়। নেয়া হয় নানারকম কর্মসূচি। সেগুলোর মধ্যে ভোরে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরি, ভিক্ষু সংঘদের পিণ্ডদান, সংঘদান, পঞ্চশীল-অষ্টশীল গ্রহণ, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, সমবেত প্রার্থনা ও বুদ্ধের বাণী সম্বলিত ভিক্ষুসংঘের ধর্মদেশনা। সন্ধ্যার পর থেকে ওড়ানো হয় ফানুস, পোড়ানো হয় আতশ বাজি। ভিক্ষুসংঘ বুদ্ধের দেশিত বাণী বা সূত্র ফানুস ছুঁয়ে উৎসর্গ না করা পর্যন্ত কোনো ফানুস উড়ানো হয় না। যদি সুত্রবাণী পাঠ ব্যতীত কোনো ফানুস ওড়ানো হয় তাহলে জনমানুষ এবং বসতিদের মাঝে অমঙ্গল সাধিত হয়। তাই প্রতিটি বৌদ্ধ মাত্রই ফানুস ওড়ানোর পুর্বে বুদ্ধের বাণী মেনে চলেন বলে সমস্ত রকমের ঘটনা দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান। ফানুস যতক্ষণ পর্যন্ত ওপরের দিকে উত্থিত হতে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বৌদ্ধ নারী-পুরুষ, শিশু, কিশোর, যুবক, যুবতী, বৃদ্ধ সবাই মিলে এসময় একসঙ্গে সমস্বরে সাধু সাধু ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলে। সঙ্গে চলে বুদ্ধ কীর্তন, ঢাক, কাঁশা, মৃদঙ্গের অপরূপ বাদ্যযন্ত্রে এ এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে উদ্দীপনা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যুবকরা নেচে-গেয়ে প্রবারণা উৎসবকে জাঁকজমকভাবে পালন করে। রাতে বাসা-বাড়িতে আয়োজন করা হয় চিড়া, গুড়, নারকেল, কলা দিয়ে উৎসবের বিশেষ খাবার। খাবারের এই রীতি যুগযুগ ধরে বৌদ্ধ গ্রামগঞ্জে চলে আসছে।
বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব হলেও পর প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস উত্তোলনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের কারণে এই উৎসব জাতি ধর্ম-বর্ণ সকল মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যায়। প্রবারণার পরদিন থেকে দীর্ঘ একমাস ধরে চলে কঠিন চীবর দানোৎসব। যে বিহারে তিন মাস ভিক্ষু অধিষ্টান বা বর্ষাবাস যাপন করে না সে বিহারে কঠিন চীবর দান করা হয় না। এই একমাস গ্রাম থেকে নগরে চলে কঠিন চীবর দানের আয়োজন। কঠিন চীবর উপলক্ষে প্রতিটি বিহারের উপাসক-উপাসিকা মণ্ডলি দুই তিন মাস আগে থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নেমে পরে। বিহারে বিহারে চলে উৎসবের আমেজ। সকালে পিন্ডদান ও পূজাপর্বের কাজ শেষ করে বিকেলে চলে কঠিন চীবর দান, ত্রিপিটক থেকে বিশদ বর্ণনা এবং সমাজ-সদ্ধর্ম উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা। কঠিন চীবর দানে অংশগ্রহণ করেতে ধর্মালোচক, ভিক্ষুসংঘ ও অতিথিবৃন্দরা দলেদলে ছুটে আসেন। কেউ ধর্মদান করে কেউ শ্রবণ করেন। কঠিন চীবর দানকে কেন্দ্র করে সামাজিক দায়িত্বও পালন করে থাকে। শিশু কিশোরদের অনুপ্রাণিত করার জন্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, এছাড়া বড়দের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। মেধাবী শিক্ষার্থিদের সংবর্ধনা যেমন থাকে তেমনি থাকে যারা দীর্ঘবছর ধরে সমাজ উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে তাদেরকে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জানানো হয় সম্মাননা-সংবর্ধনা এবং বিগত একবছরে যারা প্রয়াত হন তাদেরকে বিশেষভাবে স্মরণ করে পুণ্যদান করাও কঠিন চীবর দানের অন্যতম অনুসঙ্গ। আমি মনেকরি এ জাতীয় কাজগুলো যত বেশি করা যায় ততোই মঙ্গল। কারণ ভালো কাজের অনুপ্রাণিত করার চেয়ে মহৎ আর কিছু নেই।
বাংলাদেশ ধর্মীয় অনুভূতিপ্রবণ দেশ। আর যাই হোক ধর্মের কথা বললে মানুষ একাট্টা হয়ে যায়। সেটা যে ধর্মেরই হোক না কেনো। প্রত্যেক ধর্মের গুরুরা চাইলে স্বস্ব সম্প্রদায়ের আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি ধর্মীয় গুরুরা তাদের দায়িত্ব থেকে এখন অনেকটা দূরে সড়ে গেছে। অনেকে ধর্মের আবরণ গায়ে মেখে লাভ সৎকারের নেশায় মেতে উঠেছে। সঠিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে যদি সমাজ পরিচালিত করা যায় তাহলে দেশজুড়ে এত অবক্ষয়ের জন্ম হতো না। তাই ধর্মীয়গুরুদের আগে সঠিক ধর্মচর্চানুশীলনে মনোনিবেশ করা দরকার। এখন অনেকের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হয়েছে সংঘদানের মাধ্যমে মোটাংকের অর্থ ব্যয় করেন। তার আগে প্রতিজ্ঞা করতে হবে বুদ্ধনীতির পঞ্চশীল মানেন কিনা। সত্যকে সত্য বলেন কিনা, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেন কিনা। যদি এগুলোর কোনটাই আপনি না মানেন তাহলে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে সংঘদানের কোনো গুণ আপনার কল্যাণে আসবে না। তাহলে বুঝতে হবে এই অর্থ ব্যয় দানের জন্য নয়, নামের জন্য।
অতএব আসুন, প্রত্যেকে মহামানব গৌতম বুদ্ধের অহিংসা, শান্তি, মৈত্রীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শুধু ধর্মীয় কার্যকলাপের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে মানুষ ও মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করি। প্রজন্মদের জন্য নতুন চিন্তায় উৎসাহিত করি, অসচ্ছল মানুষের পাশে দাঁড়াই। তাহলেই সুন্দর সমাজ আমরা উপহার দিতে পারবো। তবেই হবে প্রবারণা মূল সার্থকতা। ফানুসের আলো সবার অন্তর্জগত আলোকিত করুক, বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক। জয়তু বুদ্ধ সাসনম।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক