১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। কমতে থাকে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা। বাড়তে থাকে অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ। তাই ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রণয়ন করা সংবিধানে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান। এরপর ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই তিনি তৎকালীন সময়ের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি ঘোষণা করেন। দেড় লাখেরও বেশি শিক্ষকের দায়িত্ব নেন নিজ কাঁধে।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষকতা শুরু করি। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে আমার মতো দেড় লক্ষাধিক শিক্ষকের চাকরি ও ৩৬ হাজারের বেশি বেসরকারি স্কুল সরকারি করা অতীব কঠিন কাজ ছিলো।
স্বাধীনতার আগে স্কুলগুলো পরিচালিত হতো জেলা বোর্ডের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষকদের অংশগ্রহণ ছিলো সর্বাধিক। তাদের অনেকেই শহীদ হন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে রেডক্রসের দেয়া টিন ও টাকায় সারাদেশে স্থানীয়ভাবে স্কুলগুলো সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ফকিরাপুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। এরপর নতুন স্কুলগুলোর আবেদন জানানো হয় তৎকালীন সরকারের কাছে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৬ হাজার ১৬৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। তখনও নিয়োগকৃত শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণে যাচাই বাছাই হয়েছিলো।
তখন সরকারিকৃত স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ বা আগের শিক্ষকদের যাচাই বাছাইয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। তৎকালীন মহাকুমা প্রশাসকে সভাপতি ও মহাকুমা শিক্ষা অফিসারকে সদস্য সচিব করে গঠিত ওই কমিটির সদস্য ছিলেন সারাদেশের সংসদ সদস্যরা। ঢাকা মহানগরীর স্কুল হওয়ায় আমার নিয়োগ প্রক্রিয়ার কমিটিতে ছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। এ কমিটিতে আরও ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও গাজী গোলাম মোস্তফা। তখন শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা ছিলো এসএসসি পাস। কমিটি তৎকালীন শিক্ষকদের শিক্ষা সনদসহ নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে শিক্ষকদের চাকরি সরকারি করেন। যাচাই শেষে ঢাকার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক নিয়োগপত্র জারি করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষক হিসেবে প্রথম সরকারি বেতন পাই।
প্রথম বকেয়াসহ ২ হাজার ২০০ টাকা বেতন পেয়েছিলাম। তখন তা ছিলো অনেক টাকা। তখন মাসিক বেতন ছিলো ১৯০ টাকা। এর মধ্যে ১৪৫ টাকা মূল বেতন ও ৪৫ টাকা ছিলো বাড়িভাড়া। তৎকালীন অ্যাকাউন্টস অফিস থেকে বেতনের টাকা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সোনালী ব্যাংকের শাখায় আমার পিটি (প্রাইমারি টিচার) অ্যাকাউন্টে এসেছিলো।
সরকারিকরণের আগে বেতন দিতে পোস্ট অফিসের পিয়নরা শিক্ষকদের ঘোরাতেন। পাকিস্তান আমলে গভর্নর মোনয়েম খানের আমলে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বঙ্গভবন ঘেরাও করে বেতন স্কেলের দাবি বাস্তবায়ন করেছিলেন। এর আগে বেতন স্কেল ছিলো না। এরপর জেলা বোর্ড থেকে প্রধান শিক্ষকদের ১৩০ টাকা ও সহকারী শিক্ষকদের ১২০ টাকা স্কেলে বেতন দেয়া হতো। সঙ্গে প্রতিবছর প্রধান শিক্ষকরা ৩ টাকা ও সহকারী শিক্ষকরা ২ টাকা ইনক্রিমেন্ট পেতেন।
সরকারিকরণের আগে বেতন পোস্ট অফিসের পিয়নের মাধ্যমে বিলি করা হতো। তখন পিয়নরা হাটের দিনে ভেঙে ভেঙে শিক্ষকদের টাকা দিতেন। কোনো কোনো হাটবারে শিক্ষকরা ৩০ টাকা, কোনো কোনো হাটবারে ৪০ টাকা পেতেন। যে হাটবারে পিয়ন টাকা না দিতেন সে সপ্তাহে শিক্ষকদের ঘরে বাজার যেতো না। সরকারিকরণের মাধ্যমে শিক্ষকদের এ বঞ্চনা থেকে মুক্ত করেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম