বগুড়ার কাহালু উপজেলার ঢাকন্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক যায়েদা খাতুন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে এক মাসের চিকিৎসা ছুটি নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু এরই মধ্যে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিদ্যালয়ে ফেরেননি যায়েদা। তার অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে নেওয়া ছুটির সত্যতা যাচাই করতে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে একের পর এক মেডিকেল বোর্ড বসলেও সেখানে হাজির হননি। বিদ্যালয়টির অন্য শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যায়েদা বিদেশে অবস্থান করছেন। সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতেই তিনি বছরের পর বছর প্রবাসে বসবাস করছেন।
শুধু যায়েদাই নন, কয়েক বছরে প্রাথমিকের ৪১৮ শিক্ষক বিভিন্ন সময় বিদ্যালয় থেকে নৈমিত্তিক কিংবা চিকিৎসাজনিত ছুটি নিয়ে বছরের পর বছর বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। যাদের বেশিরভাগই কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অনুপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে এরই মধ্যে ২০০ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর বিভিন্ন শাস্তির সম্মুখীন হয়ে ১৪৩ জন শিক্ষক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৭৫ জন শিক্ষক বিদ্যালয়ে যোগদান না করায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা শুরু হয়েছে।
আর এভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ছুটি নিয়ে শিক্ষকরা প্রবাসজীবন কাটানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। তাদের নিরবচ্ছিন্ন পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষকসংকটে শিক্ষার্থীরা দৈনন্দিন বিষয়ভিত্তিক পাঠগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে কয়েক ধাপের দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণের কারণ উল্লেখ করে প্রবাসে থাকা শিক্ষকদের পদ শূন্য ঘোষণা করতে সময় লাগানো হচ্ছে বছরের পর বছর। যে কারণে তাদের পদে অন্য শিক্ষকরা যোগদানও করতে পারছেন না। যদিও অভিযোগ রয়েছে, বছরের পর বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পরও চাকরি যায় না মূলত কিছু কর্মকর্তার অসৎ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের ফলে।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার ঢাকন্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. যায়েদা খাতুনের প্রবাসজীবনের কারণে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সহকর্মীদের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. হাবিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘সহকারী শিক্ষক যায়েদা খাতুন ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে এক মাসের মেডিকেল ছুটি নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। তার বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। ওই শিক্ষকের বাড়িতে গিয়েছি, শিক্ষা অফিসে অনেক ধরনা ধরেছি একটা সমাধানের জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার পদটিই শূন্য হয়নি। আর পদ শূন্য না হওয়ায় অন্য কোনো শিক্ষকও তার পদে যোগ দিতে পারছেন না। শুনেছি যায়েদা খাতুন সুইজারল্যান্ডে আছেন।’ যায়েদা খাতুনের বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার কাহালু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে যেসব কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলো নিয়মিত ডিপিইওকে (জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) জানানো হয়েছে। ডিপিইও বলতে পারবেন যায়েদা খাতুনের বিষয়ে।
পরে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তার সাড়া মেলেনি।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ভাট্টাইধোবা উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারহানা বসার স্বর্ণা গত ছয় মাসের বেশি সময় কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত। এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার বলেন, তার বেতন বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানোসহ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সহকারী শিক্ষকের ৭ হাজার ৮৬৩টি পদের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৭ হাজার ১৯৫ জন। ১৪৭৭টি প্রধান শিক্ষকের পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত ১ হাজার ১০৯ জন।
সিলেট জেলায় ইতিমধ্যে ৪৫টি বিভাগীয় মামলায় ৪০ জন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা এখনো চলমান রয়েছে। যাদের অধিকাংশ মিথ্যা তথ্যে ছুটি নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেছিলেন। বিনা অনুমতিতে দেশ ত্যাগ করার সংখ্যায় পিছিয়ে নেই মৌলভীবাজারের শিক্ষকরা। এ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ছুটি নিয়ে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করায় ২৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান। এরই মধ্যে যাদের ১১ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাখাওয়াত এরশেদ বলেন, এ জেলার লোকজনের মধ্যে বিদেশে থাকার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে কিছু মামলা ঝুলে আছে। অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে একজন শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। শিক্ষকদের অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হয়, তবে বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠদান নিরবচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করেন।
যদিও বরিশাল, খুলনা এবং চট্টগ্রামের চারজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বছরের পর বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পরও চাকরি যায় না মূলত কিছু কর্মকর্তার অসৎ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের ফলে। ৫৯ দিনের মধ্যে একাধিক ধাপ অনুসরণ করে অনুপস্থিত থাকা শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব অথচ যা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। এভাবে পদ শূন্য ঘোষণা করতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে শিক্ষকসংকটে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে দৈনন্দিন বিষয়ভিত্তিক পাঠগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ওই চার শিক্ষা কর্মকর্তা আরও বলেন, কোনো শিক্ষক কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে একাধিকবার শোকজ করে (কারণ দর্শানোর নোটিস) সন্তোষজনক জবাব না পেলে প্রতিবেদন আকারে সহকারী শিক্ষকের ক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর এবং প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিভাগীয় উপপরিচালক বরাবর প্রতিবেদন পাঠাবেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলা রুজু হবে। পরে কয়েক দফা বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আন্তরিক হলে সর্বোচ্চ দু-তিন মাসের মধ্যে এটি সম্ভব।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো শিক্ষক যখন তথ্য গোপন করে দেশ ত্যাগ করেন, তখন তিনি মূলত নিশ্চিত হতে পারেন না যে কাক্সিক্ষত দেশে গিয়ে ঠিকমতো থাকতে পারবেন কি না। ফলে যাওয়ার সময় চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন না, যাতে কাক্সিক্ষত দেশে গিয়ে টিকতে না পারলে পরে দেশে এসে চাকরিতে যোগ দিতে পারেন। আর যদি বিদেশে ভালোভাবে থাকতে পারেন, তখন আর দেশে ফিরে আসেন না। তখন কেউ কেউ নিজেদের কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে অক্ষম দাবি করে চাকরি থেকে সরে যাওয়ার আবেদন করেন। সঙ্গে চিকিৎসকের সনদ যুক্ত করে দেন, যাতে চাকরিবিহীনকালে সরকারি সুবিধা ভোগ করতে পারেন। মূলত মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজেদের অসুস্থতার কথা কিংবা প্রবাসী স্বজন বা মা-বাবার অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে দেশ ছাড়েন তারা। যাদের বড় অংশই আনঅফিশিয়াল পাসপোর্ট (সরকারি চাকরির তথ্য গোপন) করেন।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক দশম গ্রেড বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক মু. মাহবুবর রহমান বলেন, ‘একজন শিক্ষক কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে বিদ্যালয়ে যদি অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে ওই বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুরা পাঠদানের ক্ষতির পাশাপাশি তিনি শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করেছেন। এত দিন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের পদ শূন্য না হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বের গাফিলতি ও দুর্নীতি বটে। সারা দেশে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে তাই দ্রুত অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে দুই মাসের চিকিৎসাজনিত ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লাখেরাজটারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা খাতুন। এখনো ঝুলে আছে তার বিভাগীয় মামলা। আট বছর পেরিয়ে গেলেও তার চাকরিচ্যুত না হওয়ায় অবাক হয়েছেন খোদ রংপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমার দপ্তর থেকে যা যা করণীয়, তাকে চাকরিচ্যুত করতে সবই করা হয়েছে। এখনো কীভাবে তার চাকরি আছে বুঝতে পারছি না। কোনো শিক্ষক অনুমতি ছাড়া একটানা ৬০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তো তার চাকরি থাকার কথা না। এ বিষয়ে ডিডি (বিভাগীয় উপপরিচালক) মহোদয় বলতে পারবেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষক নাজমা খাতুন গুরুদণ্ডের মতো অপরাধ করেছেন। গুরুদণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের অনুমোদন দরকার হয়। সেটি চাওয়া হয়েছে, হাতে পেলেই তার পদটি শূন্য ঘোষণা হবে।’