সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলায় শিক্ষকদের পিটুনিতে নবম শ্রেণির ছাত্র রাজপ্রতাপ দাসের মৃত্যুর অভিযোগে মামলা হয়েছে। নিহত ছাত্র রাজপ্রতাপের বাবা দীনবন্ধু দাসের লিখিত অভিযোগটি আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেছে কালীগঞ্জ থানা–পুলিশ। পরে আটক চার শিক্ষককে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
মামলার পাঁচ আসামি হলেন নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোনায়েম, সহকারী প্রধান শিক্ষক এম এ মুহিত, অবকাশ চন্দ্র খাঁ, শিক্ষক মনিরুল ইসলাম ও সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী। এ ছাড়া কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে শিক্ষক মনিরুল ইসলাম পলাতক রয়েছেন। বাকি চারজনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।
পরিবার ও শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, স্কুলে জন্মদিনের কেক কাটা নিয়ে এক শিক্ষক রাজপ্রতাপ দাসের বুকে হাঁটু দিয়ে আঘাত করেন। পরে সে বাড়িতে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক ১৫ শিক্ষকের মধ্যে গতকাল রোববার রাত ৩টার দিকে ১০ শিক্ষককে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। রাজপ্রতাপ দাস কালীগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমুলিয়া ইউনিয়নের চণ্ডীপুর গ্রামের দীনবন্ধু দাসের ছেলে ও কালীগঞ্জের নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র।
কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মামুন রহমান বলেন, নিহত ছাত্র রাজপ্রতাপের গতকাল সন্ধ্যার পরপরই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করার সময় নিহত ছাত্রের ডান হাতের কুনইয়ে সামান্য আঘাতের চিহ্ন ছাড়া আর কোথায় কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তার মুখে কোনো বিষ কিংবা অন্য কোনো কিছুর গন্ধও পাওয়া যায়নি। আজ লাশের ময়নাতদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাচ্ছে না।
কালীগঞ্জ থানা-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোনায়েম, সহকারী প্রধান শিক্ষক এম এ মুহিত, অবকাশ চন্দ্র খাঁ, শিক্ষক মনিরুল ইসলাম ও সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে গতকাল রাত সাড়ে তিনটার দিকে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন নিহত ছাত্রের বাবা দীনবন্ধু দাস। আজ বেলা ১১টার দিকে অভিযোগটি মামলা হিসেব গ্রহণ করে চারজন শিক্ষককে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।
রাজপ্রতাপের এক সহপাঠীর ভাষ্য, গতকাল তার ও এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। এ উপলক্ষে সকাল ১০টার দিকে বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনের একটি ফাঁকা কক্ষে রাজপ্রতাপসহ কয়েক বন্ধু মিলে জন্মদিনের কেক কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় সহকারী প্রধান শিক্ষক এম এ মুহিতের সঙ্গে সেখানে আসেন অবকাশ চন্দ্র খাঁ, মনিরুল ইসলাম, সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরীসহ পাঁচ-ছয়জন শিক্ষক। শিক্ষকেরা তাকে ও তার সহপাঠীদের এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করেন। রাজপ্রতাপের বুকে একজন শিক্ষক হাঁটু দিয়ে আঘাত করেন। পরে রাজপ্রতাপ ও তাকেসহ চারজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। বিদ্যালয়ে জন্মদিন পালন করা হচ্ছে কেন, বলে তাদের আবারও চড়থাপ্পড় মারা হয়। এ সময় রাজপ্রতাপ ও সে প্রধান শিক্ষকের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তিনিও তাদের আবার চড়থাপ্পড় মেরে সরিয়ে দেন। পরে একটি কক্ষে আটকে তাদের আবারও লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। এসব ঘটনার পর তারা শহীদ মিনারের ওপর বসে ছিল। এ সময় রাজপ্রতাপ বলে, তার শরীর খারাপ লাগছে। বুকে ব্যথা করছে, বমি বমি ভাব হচ্ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে। একপর্যায়ে রাজপ্রতাপ বাড়িতে চলে যায়। এর ২০-২৫ মিনিট পরে সে শোনে, রাজপ্রতাপ মারা গেছে।
রাজপ্রতাপের চাচি তাপসী রানী দাস বলেন, রাজপ্রতাপ অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে এসে বলে তার বুকে ব্যথা করছে। বমি করতে থাকে। দ্রুত তাকে নলতা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নলতা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবুল ফজল মাহমুদ বলেন, ‘ওই ছাত্রকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন সে মৃত ছিল। প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হয়নি, সে আত্মহত্যা করেছে।’
অভিযুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে অবকাশ চন্দ্র খাঁ দাবি করেন, বিদ্যালয় শুরুর সময় রাজপ্রতাপসহ ১০-১২ শিক্ষার্থী তিনতলার একটি কক্ষে জন্মদিনের কেক কাটছিল। তারা কয়েকজন শিক্ষক গিয়ে তাদের এ ধরনের আয়োজন করতে নিষেধ করেন। কথা না শোনায় রাজপ্রতাপকে তিনি দুটি চড় মেরেছিলেন। অন্য শিক্ষকেরাও রাজপ্রতাপ ও কয়েকজন ছাত্রকে মারধর করেন। পরে চারজন ছাত্রকে তাঁরা ধরে প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যান।
এ বিষয়ে নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোনায়েম বলেন, শিক্ষকেরা রাজপ্রতাপসহ চারজনকে তাঁর কক্ষে ধরে নিয়ে আসেন। তাদের তিরস্কার করে বলা হয়, ‘বিদ্যালয়ে নয়, বাড়িতে জন্মদিন পালন করবে।’ পরে কাকা দেবীরজ্ঞন দাসকে ডেকে রাজপ্রতাপকে তার কাছে তুলে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার দুই-তিন ঘণ্টা পর তিনি শুনেছেন, রাজপ্রতাপ মারা গেছে। স্কুলের এসব ঘটনায় রাজপ্রতাপ বাড়ি গিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে তিনি মনে করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শেখ ফারুক বলেন, নলতা এলাকায় থমথমে অবস্থা।
কালীগঞ্জ থানা-পুলিশ জানায়, নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য গতকাল সন্ধ্যা থেকে পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।