শিক্ষক কেমন হবেন - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক কেমন হবেন

মো. রহমত উলাহ্ |

শিক্ষকতা কোনো সাধারণ পেশা নয়, একটি ব্রত। শিক্ষকতা একটি মহৎ ও পুণ্যকর্ম। সঠিক শিক্ষকতার মাধ্যমে শিক্ষক নিজেও হয়ে উঠবেন উত্তম মানুষ। শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীর পূজনীয়, তেমনি শিক্ষার্থীও শিক্ষকের পূজনীয়। বিশেষ করে নিষ্পাপ শিশুশিক্ষার্থী অধিক পূজনীয়। কেননা, শিক্ষার্থীদের নিয়েই শিক্ষকের শিক্ষকজীবন আবর্তিত। যার শিক্ষার্থী নেই তিনি শিক্ষক নন। 

সঠিক শিক্ষাদান পুণ্যকর্ম বলেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের পূজনীয়। কারণ, শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষকের এই পুণ্যকর্ম করার সুযোগ নেই। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের সন্তনকে আসল মানুষ বানানোর মহান দায়িত্ব শিক্ষকের। অকৃপণভাবে এই মহান দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সহজেই সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা লাভ করবেন একজন ভালো শিক্ষক। যিনি শিক্ষকতায় নিয়োজিত ও নিবেদিত তিনি শিক্ষার্থীর সেবা করার মাধ্যমে আজীবন করতে পারেন মহান সৃষ্টিকর্তার সেবা। যখন একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের পূজনীয় মনে করবেন তখন তিনিও হয়ে উঠবেন শিক্ষার্থীর তথা সমাজের সব মানুষের পূজনীয়।

শিক্ষার্থীরাই হবেন একজন ভালো শিক্ষকের সবচেয়ে প্রিয় পাত্র। কেবল ভালো শিক্ষার্থী নন, সব শিক্ষার্থীর প্রতিই শিক্ষকের থাকতে হবে অগাধ ভালোবাসা। ভালোবাসা দিয়েই শিক্ষক কাছে টেনে নেবেন শিক্ষার্থীদের। লালন করবেন অতি সযত্নে। শিক্ষার্থীর জান্তে ও অজান্তে তার মধ্যে শিক্ষক প্রোথিত করবেন নিজের সব ভালো দিক। শিক্ষার্থীর কল্যাণ কামনায় মনে-প্রাণে, কাজে-কর্মে, ঘুমে-জাগরণে শিক্ষক হবেন সবচেয়ে বেশি নিবিষ্ট। সব শুভ কাজে শিক্ষার্থীর সফলতাকে নিজের সফলতা মনে করে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবেন শিক্ষক। 

আবার কোনো একটি শুভ কাজে শিক্ষার্থীর ব্যর্থতাকে নিজের ব্যর্থতা ভেবে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হবেন শিক্ষক। নিজের শিক্ষার্থী ব্যর্থ হলে, সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি মনে করে নিজেকে অপরাধী ভাববেন শিক্ষক। এমনিভাবে শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আপন ও কাছের মানুষ হয়ে উঠবেন একজন ভালো শিক্ষক। তিনি শিক্ষার্থীর ভয়ের পাত্র না হয়ে হবেন পরম শ্রদ্ধার পাত্র। 

এমন শিক্ষকের সব আদেশ-নিষেধ সানন্দে শিরোধার্য করে সঠিক মানুষ হয়ে উঠবেন শিক্ষার্থী। সফল হবে শিক্ষকের শিক্ষকতা। একজন ভালো শিক্ষক আজীবন লালন করবেন জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। শিক্ষককে জ্ঞানার্জনে হতে হবে নিরলস। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হতে হবে নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি খুব ভালোভাবে জানা থাকতে হবে শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাদানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।

এছাড়া জানতে হবে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও মনোবিজ্ঞান এবং ক্রমপরিবর্তনশীল বিশ্বের পরিবর্তিত জ্ঞান, তত্ত্ব ও তথ্য। আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষককে থাকতে হবে সমৃদ্ধ। জানতে হবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সুফল-কুফল এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীকে দিতে হবে সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষা লাভে শিক্ষককে সদা-সর্বদা থাকতে হবে সক্রিয়। হতে হবে বই ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ পাঠক এবং সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক নিজে হবেন সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী। যিনি নিজে শিক্ষার্থী নন, তিনি অন্যের শিক্ষক হবেন কী করে? শিক্ষাদান শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য। আর শিক্ষাগ্রহণ শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। শিক্ষাদানের পূর্বশর্তই শিক্ষা গ্রহণ। প্রতিনিয়ত শিক্ষাদান কার্যের পূর্বপ্রস্তুতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত শিক্ষা গ্রহণ। অবশ্যই থাকতে হবে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ। 

যে শিক্ষক ভাববেন, আমি কেবল পড়াব, পড়ব না; সে শিক্ষক কখনো ভালো শিক্ষক হবেন না। শিক্ষক নিজের মধ্যে শিক্ষার সঠিক চর্চা করেই সঠিক পরিচর্যা করবেন শিক্ষার্থীর। ভালো শিক্ষক নিজের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা করবেন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, আজীবন। নিরলসভাবে অর্জন ও বিতরণ করবেন নতুন নতুন জ্ঞান। শিক্ষার্থী ও সমাজের সব মানুষকে করবেন জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ। আলোকিত করবেন দেশ ও জাতি।

একজন ভালো শিক্ষক হবেন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তার থাকবে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মতো মন-মানসিকতা। ভোগের চেয়ে ত্যাগের ইচ্ছাই থাকবে বেশি। তিনি কী পেলেন, তার চেয়ে বেশি ভাববেন কী দিলেন এবং কী দিতে পারলেন না। ভোগের চেয়ে ত্যাগেই বেশি আনন্দিত হবেন তিনি। বস্তু প্রাপ্তির নয়, জ্ঞান প্রাপ্তি ও প্রদানের সংগ্রামে অবতীর্ণ থাকবেন শিক্ষক। কেবল বস্তুগত প্রপ্তির আশায় যিনি শিক্ষক হবেন ও শিক্ষকতা করবেন তিনি কখনো প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠবেন না। কেননা, প্রকৃত শিক্ষাদানের অন্তর্নিহিত অনাবিল আনন্দ ও শিক্ষাদানের অফুরান পুণ্য থেকে তিনি বঞ্চিতই থেকে যাবেন। শিক্ষকতার প্রকৃত পরিতৃপ্তি লাভের অতল সাগরে কোনোদিন যাওয়া হবে না তার। শিক্ষার্থীর জন্য যিনি নিবেদিতপ্রাণ তিনিই পরম শ্রদ্ধেয়। তাকেই শ্রদ্ধাভরে আজীবন মনে রাখেন শিক্ষার্থী।

শিক্ষক নিজে হবেন অত্যন্ত সৎ ও ন্যায়পরায়ণ এবং তেমনি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ করে গড়ে তুলবেন তার শিক্ষার্থীদের। কখনো কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না শিক্ষক। প্রতিবাদ করবেন অন্যায়ের। ঘৃণা করবেন অন্যায়কে। সচেষ্ট থাকবেন ন্যায় প্রতিষ্ঠায়। সততার বলেই বলীয়ান থাকবেন শিক্ষক। কখনই শঠতার আশ্রয় নেবেন না কর্মে ও কথায়। ফাঁকি দেবেন না কাজে। নিজের মধ্যে লালন করবেন ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে চিন্তা করবেন শিক্ষার্থী ও সমাজের সব মানুষের কল্যাণ। নিজের শিক্ষার্থীদের বানাবেন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ।

দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে পরিপূর্ণ হবেন শিক্ষক। ভালোভাবে জানবেন দেশ-জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নিজের মধ্যে গভীরভাবে লালন ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনভাবে সঞ্চালন করবেন দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা। দেশপ্রেমে ও জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করবেন শিক্ষার্থীদের। গড়ে তুলবেন দেশের কল্যাণে জীবন বাজি রাখার মতো নাগরিক। অত্যন্ত সযত্নে লালন করবেন জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। পোশাকে-আশাকে, চলনে-বলনে, আচার-অনুষ্ঠানে ফুটিয়ে তুলবেন জাতীয় ঐতিহ্যের আলোকিত দিকগুলো। তিনি হবেন শালীন ও উত্তম ব্যবহারের অধিকারী অনুসরণীয়-অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। নিজের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে প্রতিরোধ করবেন ভিনদেশি সংস্কৃতি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুলে ধরবেন নিজস্ব সংস্কৃতির সব ভালো দিক। তখন শিক্ষকের মতোই শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে আদর্শ সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব।

অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবেন শিক্ষক। তিনি হবেন সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও বাস্তববাদী। তার আয়ত্তে থাকবে শিক্ষাদানের মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আধুনিক কলাকৌশল। একজন ভালো শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর মন-মানসিকতা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, আগ্রহ-অনাগ্রহ বোঝার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। নিজের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সবদিক থেকে প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করবেন শিক্ষক। সেই মূল্যায়নের আলোকেই দেখাবেন শিক্ষার্থীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ। দেখিয়ে দেবেন কোন পথে গেলে অধিক সফল হবে শিক্ষার্থীর জীবন। শিক্ষার্থীর সামর্থ্য অনুসারে বাতলে দেবেন পথ ও সে পথে চলার নিয়মকানুন। ধন্যবাদ দিয়ে, পুরস্কার দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, উদ্দীপনা দিয়ে প্রতিদিন বাড়িয়ে দেবেন শিক্ষার্থীদের সৎ সাহস ও কর্মোদ্যম। ঘটিয়ে দেবেন কর্মদক্ষতা, বিবেকের জাগরণ, নৈতিক শক্তির উšে§ষ, আত্মার বিকাশ ও অন্তর্দৃষ্টির উšে§াচন। দেখাবেন সঠিক স্বপ্ন, শেখাবেন উত্তম স্বপ্ন দেখা। সেই স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখার অলীক স্বপ্ন নয়, জেগে দেখার বাস্তব স্বপ্ন। শিক্ষার্থীর উন্নত জীবন রচনা করার শুভ স্বপ্ন। যা বাস্তবায়নের জন্য ঐকান্তিক হয়ে উঠবেন শিক্ষার্থী। তার কাঙ্খিত শুভ স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে হয়ে উঠবেন সফল ও সুখী-সমৃদ্ধ মানুষ। তখনই তার শিক্ষক হয়ে উঠবেন সফল শিক্ষক।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষকের থাকতে হবে প্রাকৃতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হবেন শিক্ষক। থাকতে হবে প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ঐকান্তিক ইচ্ছা। নিজে শিখবেন এবং নিজের শিক্ষার্থীদের শেখাবেন প্রকৃতির পাঠ। সেই সঙ্গে শিখিয়ে দেবেন প্রকৃতির পাঠ রপ্ত করার কৌশল। শিক্ষার্থী যেন প্রকৃতিকে বানাতে পারে তার জীবনের নিত্য শিক্ষক। নিজে নিজেই শিখে নিতে পারে প্রকৃতির সঠিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার নির্ধারিত সিলেবাস থাকলেও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সিলেবাস অনেক ব্যাপক। সেই ব্যাপকতার ভেতর থেকে প্রতিনিয়ত ভালো-মন্দ চিনে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করার শিক্ষা নেবেন ও দেবেন শিক্ষক। একজন নিবেদিত শিক্ষক যত উত্তম হবেন তার শিক্ষার্থী তত উত্তম হবে।

লেখক : মো. রহমত উলাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা 

 

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056209564208984