নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক স্তরে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়টি বাধ্যতামূলক। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আগে থেকেই বাধ্যতামূলক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়টি। তবে শিক্ষক, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও কম্পিউটার ল্যাবের অভাবে বিষয়টির শিক্ষা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে; যেন ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই শিক্ষা। হাতে-কলমের শিক্ষার বিষয়টি শিক্ষার্থীরা উতরে যাচ্ছে মুখস্থের জোরে।
আইসিটি শিক্ষার এই সংকট উঠে এসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তথ্যেও। মাউশি সূত্র বলছে, অনেক সরকারি কলেজেই আইসিটি শিক্ষক নেই। কারণ, এ বিষয়ের পদই সৃষ্টি হয়েছে ২৫৫টি। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ বিষয়ে শিক্ষকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব চার বছর আটকে আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। দেশের প্রায় সাড়ে আট হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নেই। এখনো কম্পিউটার ল্যাব তৈরি হয়নি ৩ হাজার ৮৫৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে ৩৬ হাজার ৮৪টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে মাউশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ শিক্ষক ও অবকাঠামোর সংকটে (কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম) মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আইসিটি শিক্ষা চালুর মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘আইসিটি শিক্ষা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আইসিটি বিষয়টি চালুর এত বছর পরও কেন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলাম না? এত উন্নয়ন হলেও কেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও কম্পিউটার ল্যাব তৈরি হলো না—এ প্রশ্ন আমারও।’ তিনি বলেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে আইসিটি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা এমনিতেই পিছিয়ে আছি, এখনই উদ্যোগ না নিলে আরও পিছিয়ে যাব।’
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় শিক্ষাক্রমে আইসিটি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই বছরই ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। অথচ এখনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) পদ সৃষ্টি হয়নি। সরকারি কলেজে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ২৫৫টি পদ সৃষ্টি হয়। বেসরকারি কলেজে এ বিষয়ের পদ সৃষ্টি হয় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে।
মাউশি সূত্র জানায়, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আইসিটি শিক্ষকের পদ সৃষ্টির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হলেও এখনো সুরাহা হয়নি। সরকারি কলেজে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে আইসিটি শিক্ষকের নতুন কোনো পদ সৃষ্টি হয়নি।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৩’-এর খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২৩ হাজার ৭৮৯টি। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ষষ্ঠ থেকে দশম) ১৮ হাজার ৯৬৮টি এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ ১ হাজার ৪৮০টি। কলেজ রয়েছে ৩ হাজার ৩৪১টি। মাদ্রাসা রয়েছে ৯ হাজার ২৫৯টি।
কুমিল্লার গৌরীপুরের গৌরীপুর মুন্সি ফজলুর রহমান সরকারি কলেজে সাত বছর আগে আইসিটি বিষয়টি চালু হলেও এখনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক দিয়ে কোনোমতে বিষয়টির পাঠদান চলছে। কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খন্দকার মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান বলেন, অন্য বিভাগের শিক্ষক দিয়ে চালানোয় কিছুটা হলেও প্রকৃত আইসিটি শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাউশির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের সাড়ে ১২ হাজার পদ সৃষ্টির জটিলতায় আইসিটি বিষয়ের পদ সৃষ্টিও আটকে গেছে। কারণ, একসঙ্গে সব কলেজের পদ সৃষ্টি হবে এ আশায় পৃথকভাবে কোনো কলেজে আইসিটি বিষয়ের পদ সৃষ্টি হয়নি। তিনি এ জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করে বলেন, শিক্ষক না থাকায় কলেজগুলোতে আইসিটি শিক্ষার অবস্থা শোচনীয়।
ময়মনসিংহ নগরীর নাসিরাবাদ কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষার্থী প্রায় ৭০০, আইসিটি শিক্ষক ১ জন। ১১টি কম্পিউটারের মধ্যে ৮টিই অকেজো। তিনটি দিয়ে চলছে শিক্ষা। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, শিক্ষকস্বল্পতার বিষয়টি কর্তৃপক্ষও জানে। একজন শিক্ষক দিয়ে আইসিটি ক্লাস চালানো খুব কষ্টকর।
সম্প্রতি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের তথ্য সংগ্রহ করে মাউশি। এর মধ্যে ১১ জেলার তথ্য বলছে, ১ হাজার ৩৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নেই। একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম আছে ২ হাজার ৩৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এই জেলাগুলো হলো মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ ও গোপালগঞ্জ।
মাউশির এক কর্মকর্তা জানান, প্রথম পর্যায়ে ১১ জেলার তথ্য চূড়ান্ত হয়েছে। এসব জেলায় শিগগির মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। অন্যান্য জেলার তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।
মাউশির অধীনে পরিচালিত আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক মো. সাহেদুল কবির বলেন, এ প্রকল্পের অধীনে ৩৬ হাজার ৮৪টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ১১ জেলায় পাঁচ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করা হবে।
ব্যানবেইসের ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের খসড়া প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৩ হাজার ৮৫৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই। এর মধ্যে বিদ্যালয় ২ হাজার ২২১টি, কলেজ ১৭৬টি ও মাদ্রাসা ১ হাজার ৪৬১টি।
মুখস্থবিদ্যায় নির্ভরতা
জানা যায়, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকেরা আইসিটি ও ডিজিটালপ্রযুক্তি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তাঁরা কয়েক মাসের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিছু প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারিক ক্লাস নিয়মিত হয় না। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত এ বিষয়ে ক্লাসই হয় না। অন্য বিষয়ের হওয়ায় শিক্ষকেরাও বেশি জোর দেন মুখস্থবিদ্যায়। হাতে-কলমে না শিখে শিক্ষার্থীরাও আইসিটি বিষয়ে পাস করার জন্য লিখিত অংশের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুন্সিগঞ্জের এক কলেজশিক্ষক বলেন, তিনি অন্য বিষয়ের শিক্ষক হলেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আইসিটি ক্লাস নিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়।
ফেনীর একটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী বলেন, তাঁদের আইসিটির ব্যবহারিক হয় না। শিক্ষকেরা মুখস্থ করতে বলেন।
সার্বিক বিষয়ে ২৫ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, মাউশির একটি প্রকল্পের অধীনে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সূত্র : আজকের পত্রিকা