শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসে প্রথমদিনই সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে অন্তবর্তীকালীন সরকারের মাননীয় শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘‘নতুন কারিকুলামকে কার্যকর করা সম্ভব হবেনা। যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য না, সেটিকে তো রাখা যাবেনা। যতদূর সম্ভব আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া হবে। তবে, এমনভাবে এটি করা হবে, যাতে নতুন শিক্ষাক্রমে থাকা শিক্ষার্থীদের কোন অস্বস্তি না হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছিল ২০২১সালে। এতদিন ধরে মাঠপর্যায়ের সব জায়গায় এগুলো নিয়ে গবেষণার তথ্য তৈরি হয়েছে যা আমার কাছে আছে। পাঠক্রম তো উন্নত করতেই হবে। কিন্তু যেটি তৈরি করা হয়েছে, তা বর্তমানে শিক্ষকদের দিয়ে বাস্তবায়ন করা কঠিন। সাময়িক সময়ে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করব, কিন্তু সেটা হবে ধাপে ধাপে । যাতে করে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবে বিপাকে না পড়ে সেদিকে নজর রাখব। তাদের আমরা অস্বিস্তিতে পড়তে দেবনা। আমি বলছিনা যে, শিক্ষাক্রম এখনই বাতিল করে দেব, বরং পরিমার্জন করা হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতি যেভাবে করা আছে তা বাস্তবায়ন হচেছনা। আগের কারিকুলামে ফিরে গেলে শিক্ষার্থীরা যা পড়ে ফেলেছে তার সঙ্গে মিল রাখতে হবে। সে জন্য অতি দ্রুত কিছু কাজ করতে হবে।.’’ মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন যে, এই অবস্থায় এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। তবে যে সব শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে এর মধ্যে ঢুকে পড়েছেন তাদের যাতে সমস্যা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আগাতে হবে।
এ বিষয়ে দু’ একটি প্রস্তাবনা রাখতে চাই। বছরের আটমাস চলছে। নতুন কারিকুলামের উপর লিখিত বইগুলো শিক্ষার্থীরা নাড়াচাড়া করছেন এবং বাকী চারমাসের জন্য নতুন বই তৈরি করে বিতরণ করা সম্ভব নয়। নুতন কারিকুলামের উপর লিখিত প্রাথমিকের সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য শিখনফল থেকে সহজেই প্রশ্ন তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু মাধ্যমিকের শিখনফল না থাকায় এবং তার উপর ভিত্তি করে পাঠ্যপুস্তক রচিত না হওয়ার কারণে পাঠ্য বই সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য উপযোগী নয়।ফলে পিআই দিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মাধ্যমিকের পিআই এর সংখ্যা কম থাকায় তা দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করাও সম্ভব নয়। কারণ সেখানে ফলাবর্তন পাঠের সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে অধ্যায় শেষে, মাস শেষে প্রদান করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে কোন রেকর্ড কিপিং-এর ব্যবস্থা রাখা হয়নি যা প্রাথমিকে রাখা হয়েছে। তারপরেও আমাদের এই বই-ই পড়াতে হবে কারণ এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন কোন বই প্রস্তত করা, ছাপানো ও বিতরণ করা সম্ভব নয়। আবার নতুন এই কারিকুলামে যে অবাস্তব ও অগোছালো পদ্ধতিতে মূল্যায়নের কথা বলা হচেছ সেটির বাস্তবায়নও সম্ভব নয়, আবার শিক্ষার্থীদের এতদিন দোদুল্যমানতার মধ্যে রাখাও সমীচীন নয়। তাই এ বছরের নভেম্বর- ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন বইয়ের কন্টেন্ট থেকেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন যেমন প্রশ্নোত্তর, মাল্টিপল চয়েস, ম্যাচিং, সত্য/মিথ্যা, ব্যাখ্যা করা, শূন্যস্থান পূরণ, বাক্য সম্পূর্নকরণসহ বহু ধরনের ( যে চ্যাপ্টার ও বিষয়ে যেগুলো প্রযোজ্য সেগুলো দিয়ে) প্রশ্ন তৈরি কওে ৬০ শতাংশ লিখিত পরীক্ষা নেয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। বিদ্যালয়ের শ্রেণিতে বার বার পরীক্ষা ( পাক্ষিক ও মাসিক) নিতে বলতে হবে যেগুলোর উপর ৪০ শতাংশ নম্বর খাকবে। বার্ষিক পরীক্ষা মাউশি নভেম্বরের শেষের দিকে কিংবা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নেয়ার তারিখ ঘোষণা করতে পারে।
আরো পড়ুন: নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন যোগ্য নয়, আগেরটায় ফেরার চেষ্টা করবো : শিক্ষা উপদেষ্টা
২০২৫সালের জানুয়ারি থেকে পূর্ববর্তী কারিকুলামের (২০২২ সালের বইয়ের) ওপর তৈরি বইপুস্তক বিশেষ করে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে লিখিত পরীক্ষা পরিচালনা করা হলে বর্তমানের সব ধরনের জটিলতা কমে যাবে কারণ ঐ বইগুলোর কনটেনন্টের উপর শিক্ষকদের পরিচিতি আছে এবং তারা প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। তবে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমনভাবে তৈরি করার নির্দেশনা দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের নিজের চিন্তা করে লিখতে হয়। তারা সহকারী বা সাহায্যকারী পুস্তকের সাহায্য নিলেও শিক্ষার্থীদের যাতে নিজের চিন্তা করে উত্তর প্রদান করতে হয়, তাদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কীল যাতে শাণিত হয় প্রশ্নপত্র সেভাবে প্রণয়ন করার জন্য এনসিটিবি নির্দেশনা দিতে পারে। শ্রেণিকার্যক্রমেও জোর দিতে হবে এবং পাক্ষিক ও মাসিক পরীক্ষার নম্বর ও শ্রেণিতে উপস্থিতি ও অংশগ্রহন ইত্যাদি বিষয়ের উপর শতকরা ৪০ নম্বর থাকা প্রয়োজন। লিখিত পরীক্ষায় ৬০শতাংশ নম্বর থাকা বাঞ্জনীয়।
এর সাথে দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপ শুরু করা যেতে পারে যার মাধ্যমে পূর্ববর্তী কারিকুলাম কিছুটা সংশোধন করে প্রতিটি বিষয়ে কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ নম্বর হবে পারফরম্যান্সবেজড অর্থাৎ অনেকটাই প্রাকটিক্যাল টাইপের আর লিখিত পরীক্ষায় ৭৫-৮০ শতাংশ নম্বর রাখা যেতে পারে। কারণ একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে যাচেছন অথচ জনসম্মুখে কথা বলতে পারছেন না। সেজন্য তাকে যোগাযোগ দক্ষতা ও উপস্থাপন দক্ষতা শিখতে হবে। সেটি শ্রেণিকক্ষে প্রাকটিস করানো হবে এবং তার উপর নম্বর থাকবে । বাস্তব জ্ঞান অর্জন ( প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান যে কোন বিষয়েই এ ধরনের একটি প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা থাকবে এবং তাতে নম্বর থাকবে ২০-২৫শতাংশ। একজন শিক্ষার্থী ভাল গান করেন অথচ তার সার্টিফিকেটের কোথাও তা লেখা থাকেনা যদিও এটি একটি অন্যতম গুণ। সেটির জন্য নম্বর থাকবে। সবাই গান করতে পারবেন না, এটিই স্বাভাবিক কিন্তু শ্রেণির অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ নাচতে পারেন, কেউ ভাল ছবি আঁকতে পারেন, কেউ ভাল নাটক করতে পারেন এ ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য নম্বর থাকবে যা ঐ ২৫ শতাংশের মধ্যে।
১১আগস্ট থেকে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি মোটামুটি সাধারন অবস্থায় পৌঁছেছে কিন্তু শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয়সমূহ এক দ্বিধাদন্দ্বের মধ্যে আছেন। তারা যেহেতু মাউশি কিংবা এনসিটিবি থেকে কোন ধরনের নিদের্শনা পাননি যে, চলমান ষাণ¥াসিক মূল্যায়ন কি চালিয়ে যাবেন না বন্ধ রাখবেন। তারা কি নতুন কারিকুলামের ওপর লিখিত বই পড়াবেন না বাদ রাখবেন। এই বই-ই কি থাকবে না নতুন কোন নির্দেশনা আসবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষকরা জানাচেছন যে, তারা বুঝতে পারছেন না এ অবস্থায় তারা কি করবেন। ষান্মাসিক মুল্যায়ন নিয়ে যা করা হয়েছে সেটি কোন মূল্যায়ন নয়, বরং এক ধরনে প্রহসন। কারন শ্রেণির সকল শিক্ষার্থী বসে একটি বাজারের মতো অবস্থায় একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন যেখানে ৩-৫শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রকৃত অংশগ্রহন ছিল বাকীরা নীরব দর্শক কিংবা দুষ্টুমিতে ব্যস্ত ছিল কিন্তু সবাই একই ধরনের উত্তর আংশিক এবং দু চরাজন পূর্নরূপ লিখেছেন। এটি কোন ধরনের মূল্যায়ন নয় অথচ এটি করতেই কর্তৃপক্ষের সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর।এদিকে শিক্ষার্থীরা যদিও ক্লাসমূখী হয়েছেন কিন্তু বই মুখী হননি। শিক্ষকরা বই ধরলেই তারা বলেন যে, স্যার/ম্যাডাম এই বই আর পড়বনা। এই কারিকুলাম তো আর থাকছেনা। আমাদের নতুন কিছু পড়ান। এ অবস্থায় শিক্ষকরা পড়েছেন মহা বিপদে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এই বিপদ থেকে দ্রুত উদ্ধার করতে হবে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক