দৈনিক আমাদের বার্তায় প্রকাশিত একটি খবরে দেখলাম, একটি বেসরকারি সংস্থা ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা: পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়’ শীর্ষক একটি সমীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে যাতে উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ওই সমীক্ষার ফলে জানানো হয়, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সারা দেশে মোট ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে স্কুল পড়ুয়া ২২৭ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ১৪০ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী ৪৮ জন। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা করা মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ২০৪ জন অর্থাৎ ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ছাত্রী ৩০৯ জন অর্থাৎ ৬০ দশমিক ২ শতাংশ। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৪১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যা মোট হননকারীর ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
এখানে আরো কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো- ইয়ংদের মধ্যে আবেগ বেশি থাকে, তাই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নারীদের মধ্যে আবেগের প্রবণতা বেশি। তাই আত্মহত্যার দিক দিয়েও তাদের সংখ্যাটিই ওপরে। স্কুল শিক্ষার্থীদের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা বেশি বাস্তববাদী। তাই তাদের মধ্যে এ হার কম। আঁচল ফাউন্ডেশনের একদল গবেষক দেশের ১০৫টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার এ তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ১৪৯ জন শিক্ষার্থী। এরপরই অবস্থান করছে চট্টগ্রাম বিভাগ, এই বিভাগে আত্মহত্যা করেছেন ৮৯ জন। এছাড়াও রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনায় ৬৪ জন, বরিশাল ও রংপুর উভয় বিভাগেই ৪৩ জন করে, ময়মনসিংহে ৩৬ জন এবং সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আমরা সহজেই বুঝতে পারি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো মেগাসিটিতে নাগরিক সমস্যাগুলো বেশি। প্রকৃতি থেকে দূরে অবস্থানকারী এই বাণিজ্যিক ও নগর সভ্যতার প্রভাব বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে সহায়তা করেছে। বিশেষজ্ঞরাও প্রায় একই ধরনের মতামত প্রকাশ করে বলেছেন, ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ না থাকায় এখানে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দে সারাদেশে আত্মহত্যা করা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ৫৩২ জন। দেখা যাচ্ছে ২০২২ ও ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীরা সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। সংস্থাটি বলছে, এসব শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো ‘অভিমান’ । এ কারণে ১৬৫ জন বা ৩২ দশমিক ২ শতাংশ আত্মঘাতী হয়েছেন। এর পরেই আছে ‘প্রেমঘটিত কারণ’। এ কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়াও মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। পারিবারিক কলহজনিত কারণে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে পড়াশুনার চাপের সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ান ৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ করেন ১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অপমানবোধ করে আত্মহত্যা করেন ০ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
৫১৩ জন শিক্ষার্থীর ৬০ দশমিক ২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত এক বছরে আত্মহত্যা করেছেন। শুধু নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা যায়, ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ অভিমানে, ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রেমঘটিত কারণে, ৮ দশমিক ৪ শতাংশ মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে, ৭ দশমিক ১ শতাংশ পারিবারিক বিবাদের কারণে, ৩ দশমিক ৯ শতাংশ যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছেন। ৪ দশমিক ২ শতাংশ পড়াশোনার চাপজনিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় একই সংখ্যক শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এছাড়া পারিবারিক নির্যাতনে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, অপমানে ০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
সংগঠনটি জানিয়েছে, আত্মহননকারীদের মধ্যে প্রায় দশভাগ মানসিক সমস্যার কারণে এই পথ বেছে নিয়েছেন। আর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ গবেষণা বলছে, কিশোর-কিশোরীদের প্রায় ১৩ ভাগ মানসিক রোগে আক্রান্ত। দেশের তিন কোটি মানুষ মানসিক রোগগ্রস্ত। চূড়ান্ত হতাশার কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার পেছনে অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ আছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অস্থিরতা যারা নিতে পারেন না, তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তাদের ওপর পরিবারের চাপ আছে চাকরি বা কর্মসংস্থানের। সমাজও তাদের নানা কথা বলে। কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে পরিবারের সদস্য এবং বাইরে লোকজনের সঙ্গে ‘জেনারেশন গ্যাপ’ দিন দিন বাড়ছে ।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৪৮ দশমিক ৪ ভাগ মানসিক রোগী। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ৩৪৭ জন রোগীর ওপর গবেষণা করে ওই তথ্য প্রকাশ করে। ওই রোগীদের মধ্যে ১৬৮ জন কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছিলেন। পোশাককর্মী ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’ এর প্রতিষ্ঠাতা বলেন, পোশাক কর্মীদের ২০ শতাংশ নানা ধরনের মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। তারা মূলত তাদের পরিবার, সন্তান ও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চাপে থাকেন। মানসিক অস্থিরতায় থাকেন।
নারীরা নানা ধরনের অ্যাবিউজের মধ্যে দিয়ে যান যা তাদেরকে মানসিকভাবে আক্রান্ত করে। তরুণরা নানা ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক চাপে পীড়িত থাকেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘২০০৫ ও ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের গবেষণায় আমরা দেখেছি, তখন ১৬ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগী ছিলেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে সেটি হয়েছে ১৮ শতাংশ। মানসিক রোগীর সংখ্যা এভাবে বেড়ে যাচ্ছে, আর তার চেয়ে বেড়েছে আত্মহত্যার হার। এটি বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীতেই বেড়েছে।’ সামাজিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, অসহিষ্ণুতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া, পরমৎ সহিষ্ণুতার অভাব, মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, মাদকাসক্তি এবং মানুষের যন্ত্র নির্ভরতা এর জন্য দায়ী। এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, আমাদের দেশে আত্মহত্যা ফৌজদারী অপরাধ ও পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে কারোর মধ্যে কোনো কারণে আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগলেও ভয়ে সে তা প্রকাশ করে না। তাই আমাদের আইন ও মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।