দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: বর্তমানে ৩৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নেই পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও পরীক্ষার হলরুম। অধিকাংশ কলেজে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষকও। লেগে আছে ভয়াবহ সেশনজট। দেশের স্নাতক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়াশোনা করছে।
এটি নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবার থেকে উচ্চ শিক্ষায় আসা সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্রদের আশ্রয়স্থল। তবে উচ্চ শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি অবহেলা আর উদাসীনতার শিকার এই বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে সেশন জট নিরসনের উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও কার্যত ভোগান্তি ও সেশনজট কোনোটিই কমেনি, উল্টো বেড়েছে। বিগত কয়েক বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় কমছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বছরে একজন শিক্ষার্থীর পিছনে ব্যয় করছে মাত্র ৭০২ টাকা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী প্রতি যে ব্যয় করা হয়, সে তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যয় অনেক কম। এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে।
জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি বেসরকারি কলেজ রয়েছে ২২৫৭টি। এর মধ্যে সরকারি কলেজ রয়েছে ৫৫৫টি। এতে সব মিলিয়ে ৩৪ লাখ ২৫ হাজার ৮৩২ জন শিক্ষার্থী পড়াশেনা করছে। আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে ৬টি। শতবর্ষী কলেজ রয়েছে ১৬টি। আর বেসরকারি কলেজ রয়েছে ১ হাজার ৩৬১টি।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য শুরু হয়। অর্থাভাবে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ হয় না নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। এদিকে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয়ে এমন অসামঞ্জস্যতার কারণে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এক ধরণের বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিমত শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের।
ইউজিসির ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষার্থীদের পেছনে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় ৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। অন্যদিকে শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় মাত্র ৭০২ টাকা। প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৭৪৩ টাকা। আর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এই মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১ হাজার ১৫১ টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, এতে শিক্ষায় এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বল শিক্ষা কাঠামোর কারণে এ ঘটনা ঘটছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোকে আশপাশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বাড়বে। এতে বৈষম্য দূর হবে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী প্রতি তাদের ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৫ টাকা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা। শিক্ষার্থী প্রতি বেশি ব্যয়ের দিক থেকে এর পরের অবস্থানে রয়েছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী প্রতি তাদের ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
অন্যদিকে শিক্ষার্থী প্রতি কম ব্যয়ের দিক থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় ৩ হাজার ৪১৫ টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় হয়েছে ৪৩ হাজার ২২ টাকা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় হয়েছে ৪৪ হাজার টাকা।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় ২ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ টাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ এক হাজার ৭৭৮ টাকা, বুয়েটে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৭৭ টাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৯০ টাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা, শাবিপ্রবিতে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৯১ হাজার ৩০৯ টাকা, হাবিপ্রবিতে ৯২ হাজার ২৪২ টাকা, মাভাবিপ্রবিতে এক লাখ ৫৩ হাজার ১৭৮ টাকা, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯০০ টাকা, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৮ হাজার, চুয়েটে ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা, রুয়েটে ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৯ টাকা, কুয়েটে ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা, ডুয়েটে ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৫ টাকা, নোবিপ্রবিতে ১ লাখ ২৪ হাজার ২৩১ টাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮১ হাজার, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭১ হাজার ৫৬৯ টাকা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি তার পরিবারকে দেখাশোনাসহ বিভিন্ন কাজে লিপ্ত থাকে। উচ্চ শিক্ষার মান কমিয়ে তাদের কারিগরি দিকে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। যারা বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে, তাদের এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত।
সূত্র: যুগান্তর