শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড-এ কথা আমরা বহুবার শুনেছি, এবং এটি সত্যও বটে। তবে, শিক্ষা যদি সঠিক পথে পরিচালিত না হয়, তবে জাতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য সঠিক শিক্ষানীতি গঠন জরুরি, যা একমাত্র একটি কার্যকর শিক্ষা কমিশন দিয়েই সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ইতোমধ্যে ছয়টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও কার্যকর কোনো ফলাফল আমরা দেখতে পাইনি।
বর্তমান প্রজন্মের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে তরুণ শিক্ষকদের জাগ্রত করা প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন যতই সহজ হোক, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে তরুণদের সুসংগঠিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো, বয়স্ক শিক্ষকদের অনেকেই নিজেদের স্বার্থের দিকে বেশি মনোযোগী। তাই, শিক্ষা খাতে সত্যিকার উন্নয়ন ঘটাতে তরুণ শিক্ষকদের এগিয়ে এসে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশে তিনটি বড় রাজনৈতিক যুগান্তর ঘটেছে। তবে, বিস্ময়ের বিষয় হলো, গত ৫৩ বছরে আমাদের সম্মানিত শিক্ষক সমাজ শিক্ষাকে জাতীয়করণ বা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এর প্রধান কারণ শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তি। যেই সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, তারা শিক্ষকদের একটি গোষ্ঠীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, ফলে শিক্ষা খাত উপেক্ষিত থেকে গেছে।
এখন সময় এসেছে সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের একযোগে কাজ করার। শিক্ষার জাতীয়করণ এবং স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এজন্য শিক্ষকদের উচিত সরকারের সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক আলোচনায় বসা, বিশেষ করে শিক্ষা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। একটি শিক্ষানীতি সংস্কার কমিশন গঠন করা অত্যন্ত জরুরি, যা শিক্ষকদের জন্য সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো প্রণয়ন করবে এবং শিক্ষা খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে দিকনির্দেশনা দেবে।
আমরা প্রায়ই নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি শুনি, যেমন ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে বেসরকারি শিক্ষাকে জাতীয়করণ করবো।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা কেনো এখনই এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে না? বর্তমান সরকারের কাছে এই দাবিগুলো উত্থাপন করলে তা শিক্ষার জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। শুধু নির্বাচনের সময় নয়, এখনই এই দাবি তুললে সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে বাধ্য হবে।
শিক্ষা সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কাঠামো শিক্ষকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তাদের মর্যাদা ও কাজের প্রতি উৎসাহ বাড়াবে। একই সঙ্গে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রশাসন কিভাবে পরিচালিত হবে, তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও এই কমিশনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। এনসিটিবি, নায়েম, এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় আনাও অত্যন্ত জরুরি, যাতে করে শিক্ষাব্যবস্থা আরো কার্যকর ও প্রভাবশালী হয়।
যদি বর্তমান সরকারের আমলে এই উদ্যোগ নেয়া না হয়, তবে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে, যেমন তারা অতীতেও করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কার আজ জরুরি, যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের স্বার্থ রক্ষিত হয়। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বাজেটের ঘাটতি একটি অজুহাত মাত্র। অতীতের সরকারগুলো বিলাসবহুল প্রকল্পে প্রচুর টাকা খরচ করেছে, যা জনগণের কোনো উপকারে আসেনি। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে শিক্ষার উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে, দীর্ঘমেয়াদে তা জাতির অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হতে পারে।
এখন সময় এসেছে সব স্তরের শিক্ষকেরা একত্রিত হয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত থেকে শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই একটাই পরিচয় ধারণ করি-আমরা শিক্ষক, আমাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষার উন্নতি সাধন করা।
শিক্ষা খাতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে একজোট হয়ে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জাতীয়করণ ও শিক্ষানীতি সংস্কারের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব, যা কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, এবং সমাজের নানা অন্যায় দূর করতে সহায়ক হবে। শিক্ষার মাধ্যমে উদারতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য বেসরকারি শিক্ষাকে জাতীয়করণ ও একটি শক্তিশালী শিক্ষা কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি। এমন উদ্যোগের মাধ্যমেই শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং শিক্ষা খাতের অসমতা দূর হবে। সঠিক শিক্ষানীতির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে।
সর্বোপরি, জাতীয় শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সম্মিলিতভাবে একটি শক্তিশালী আওয়াজ তুলতে হবে, যাতে শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক: সহ-সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটি, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ফোরাম