শিক্ষাকে বলা হয়ে থাকে জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়াও একটি জাতি উন্নতি ও সমৃদ্ধির শেখরে দাঁড়াতে পারে না। বিশ্বের বুকে যে জাতি যতো বেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততো বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। শিক্ষা ছাড়া একটি রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে চাইলে শুধু এর শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিলেই চলে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখবো-একটি জাতিকে ধূলিসাৎ প্রকল্পে শিক্ষার ওপরই আক্রমণ হয়েছে সবার আগে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনেক বড় বড় যুদ্ধে বিজয়ীশক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরি ধ্বংস করে দিয়েছে যেনো সে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে না হতে পারে।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার তৎকালীন শিক্ষাসচিব এসএম শরিফের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে প্রণয়ন করলো চরম বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি, যা 'শরিফ কমিশন' নামে পরিচিত। ‘টাকা যার শিক্ষা তার’-এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে তুলে দেয়ার প্রস্তাবসহ একটি সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি এদেশের জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইল তৎকালীন আইয়ুব সরকার। এ চরম বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত ছাত্রসমাজ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর হরতাল আহ্বান করে এবং এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ।
১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সমাবেশে উপস্থিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। খবর আসে জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে। মিছিল তখন দ্রুত নবাবপুরের দিকে যায়। হাইকোর্টে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে মিছিল আব্দুল গনি রোড ধরে যেতে থাকে। পুলিশ তখন পেছন থেকে মিছিলে হামলা চালায়। পুলিশের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ বাধে ঢাকা কোর্টের সামনে। এখানেও পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায়। এতে বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ–৩ জন শহীদ হন, আহত হন শতাধিক এবং শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ওইদিন দিন শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। টঙ্গিতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিককে। পিচঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হলো। রাজপথকে নরকপুরীতে পরিণত করে পিছু হটলো স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার। পারলো না বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে। পরবর্তী সময়ে একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আর ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিনটি প্রতিষ্ঠা পায় ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের অভ্যুদয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে শিক্ষার সর্বজনীন অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন।
সেই সময়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকার ৯ সেপ্টেম্বর ১৪৪ ধারা জারি করে শোভাযাত্রা, পিকেটিং নিষিদ্ধ করলেও ১০ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে দশজনকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকায় মিছিল করে। পুলিশ আবুল হাসনাত, আব্দুর রহিম আজাদ, আবু হেনা, কাজী জাফর আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করে। ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল না করলে সারা পূর্ব-পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী জাতীয় পরিষদে এই রিপোর্ট বিবেচনার প্রস্তাব দেন। ১৬ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় আসেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৬ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দেন সরকার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বিবেচনা করবে। কিন্তু ছাত্ররা তাদের হরতালের কর্মসূচী ঠিক রাখে। ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ সারা পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভ, লাঠিচার্জ এবং গুলি চলে। ঢাকায় ৫২ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মোট আহতের সংখ্যা ছিলো ২৫৩ জন, ১০৫৯ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। দুপুরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সামরিকবাহিনী নামানো হয়। নবাব হাসান আসকারির গাড়ী আক্রান্ত হয়, নিহত হন গোলাম মোস্তফা। ১৮ সেপ্টেম্বর মৌন মিছিল বের করা হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ১৪৪ ধারা জারি থাকে।
দীর্ঘ লড়াই, সংগ্রাম করে, রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র, স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা। পেয়েছি একটি শিক্ষা দিবস। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় হলো, এ দিবসটি এখন বাম প্রগতিশীলরা ছাড়া তেমন কেউ মনে রাখে না। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা দিবসের ৬২ বছর পরও ছাত্রসমাজের সর্বজনীন শিক্ষার যে আকাঙ্ক্ষা, তা আজও পূরণ হয়নি। কিছুটা সংশোধন হলেও সেই ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলে কেরানি ধাঁচের নির্মিত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। শিক্ষা ও ছাত্র আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ এ ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই অজানা রয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের এ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা। তারা বঞ্চিত হচ্ছে এর তাৎপর্য অনুধাবন থেকে।
শিক্ষা এখনো বাজারে ওঠে, চলে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা। তবে পার্থক্য একটাই—আগে বিক্রি হতো খোলাবাজারে আর এখন বিক্রি হয় সুসজ্জিত শোরুমে। হুহু করে বাড়ছে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে পড়তে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা দেশের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। তা ছাড়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শিক্ষার গুণগত মান। অবশেষে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে গিয়ে আমরা পেয়েছি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০। যেখানে চমৎকার সাবলীল ভাষায় ও কৌশলে দেয়া হয়েছে 'শুভঙ্করের ফাঁকি'।
শিক্ষা দিবসের চেতনায় ওঠে আসা সর্বজনীন, বৈষম্যহীন এবং একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষাকে করা হয়েছে বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ। যার প্রভাবে সারা দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা-সর্বস্তরেই চরম নৈরাজ্য চোখে পড়ছে। দেশে এখনো রয়ে গেছে শিক্ষক সংকট। এখনো বিভিন্ন ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের আমৃত্যু অনশনে যেতে হয়—যা শিক্ষা দিবসের চেতনার পরিপন্থী।
আমাদের স্মরণে রাখা উচিত সেদিন ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল ও গোলাম মোস্তফাদের রক্ত রাজপথে শুকিয়ে যায়নি, সঞ্চালিত হয়েছিলো জাতির ধমনিতে, মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায়। আর ওই রক্তের স্রোত গিয়ে মিশেছিলো আরেক রক্তগঙ্গায়। অবশেষে গিয়ে মিলিত হয় স্বাধীনতার মোহনায়।
তাই দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সর্বজনীন মতামতের ভিত্তিতে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষা হবে সবার জন্য অবাধ। ‘শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা সবার অধিকার—এটি সর্বস্তরে প্রতিফলিত হোক।
তাৎপর্যপূর্ণ মহান শিক্ষা দিবসের ইতিহাস মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিনটি পালনের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা দিবসের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গ্রাম ও শহরের মাঝে শিক্ষার যে বৈষম্য বিরাজমান তা দূর করতে হবে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলতে হয় বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো শিক্ষানীতির কার্জকর নেই, বহুবিধ ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা চলছে, শিক্ষা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় সিলেবাস ভারাক্রান্ত, শিক্ষার নামে অবাধে চলছে সার্টিফিকেটবাণিজ্য, শিক্ষার মান আশঙ্কাকাজনকভাবে নিচে নেমে এসেছে। আমাদের পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে, কিন্তু অর্জিত হচ্ছে না 'কাঙ্ক্ষিত মান'। যার নজির আমাদের বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যায়। ফলে কোয়ালিটি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা দূরে সরে আছি।
আমাদের শিক্ষার মান বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ দিনদিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অপরাজনীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর অপশাসনে ভারাক্রান্ত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব হলো শিক্ষার্থী। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বড়ো বড়ো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে এসে এখানে অনিয়ম, অপশাসন, অব্যবস্থাপনার বেড়াজালে আটকা পড়েন। এসব বেড়াজালে অনেককেই জীবন বলি দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো গবেষণা। অথচ এখানে নেই গবেষণা, নেই গবেষণার গুরুত্ব, অন্যের থিসিস চুরি করে ডিগ্রী নেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে শুধু ‘আমলা-কেরানি’ তৈরির কারখানায়।
এখানে মুক্তচিন্তার চর্চা নেই, মুক্তমতের স্বাধীনতা নেই, নেই সাংস্কৃতিক চর্চা। দাসত্ব, তেলবাজী, চাটুকারিতা, মেরুদণ্ডন্ডহীনতায় ভর দিয়ে চলছে এখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। গুণগত শিক্ষা সংকট, আবাসন সংকট, সুষম খাদ্যের অপ্রতুলতা, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা—এসব মৌলিক সংকট ও সমস্যায় জর্জরিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
কোনো আন্দোলনের সূত্রপাত হলেই এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দায় গিয়ে ঠেকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। কথায় কথায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নজির একমাত্র এদেশেই রয়েছে। কিন্তু সেশনজট, অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিরসনে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উপাচার্য মিথ্যে বয়ান দিয়ে বেড়ান—তার বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি কোনো সেশনজট নেই! একটা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে পরিচালিত হবে, কেমন মান থাকবে, কেমন পরিবেশ বজায় থাকবে—এসব কিন্তু সার্বিকভাবে একজন উপাচার্যের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগকৃত উপাচার্যরা প্রকৃতপক্ষে উপাচার্য পদের জন্য কতোটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন—সে প্রশ্ন না ওঠে পারে না।
দেখা যায়, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা, লবিং-এর বলে অনেক অযোগ্যই গুরুত্বপূর্ণ এ যোগ্যপদ দখল করে নিচ্ছেন। একসময় দেখা যেতো, দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এবং বরেণ্য যোগ্যব্যক্তিত্বরাই উপাচার্য হতেন—যারা মেরুদন্ডসম্পন্ন প্রসাশক—যাদের প্রকৃতঅর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিচালনা করার যোগ্যতা থাকতো। আর এখন কারা উপাচার্য হয়ে থাকেন—সেটা কারোরই অজানা নয়। আর এ কারণেই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করুণ দশা। একটা দেশের ভবিষ্যৎ বোঝা যায় সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দেখে। আমাদের যে বহুমাত্রিক সংকট—সেসবের জন্য আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেরুদণ্ডহীনতা দায়ী।
অথচ এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে জনগণের ট্রেক্সের টাকায়—সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। রাষ্ট্রের যে এতো বড়ো বিনিয়োগ—রাষ্ট্র কি কোনোদিন সে হিসেব কষেছে যে, আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী দিচ্ছে—আমি কী আউটকাম পাচ্ছি? আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এখান থেকে কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে? কোথাও কোনো জবাবদিহিতার তোয়াক্কা নেই!
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর প্রকৃতঅর্থে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেখানে শিক্ষার মান কতোটুকু বাড়ছে—সে প্রশ্ন না ওঠে পারে না। আমরা জেলায় জেলায় বা মোড়ে মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই না, যেগুলো আছে সেগুলোর মানোন্নয়ন চাই, সেগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই, সেগুলোকে প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেখতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসনের নামে দাসবৃত্তি করছে। ফলে তারা তাদের নিজেদের শক্তি সামর্থ্য নিজেরা কাজে লাগাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগের মতো সুস্থ ধারার রাজনীতি নেই, নেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে দেখা যায় অস্বচ্ছতা; অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অনিয়মে ভারাক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়সূহ। রাজনৈতিক লবিং-এ ছেয়ে গেছে উচ্চশিক্ষার উচ্চ পদগুলো। ফলে শিক্ষা তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হচ্ছে। আর তাই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান দিনদিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। এখনই এসবের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আমাদের উচ্চশিক্ষার পথ অচিরেই অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে।
শিক্ষা নিয়ে বানিজ্য, শিক্ষায় বৈষম্য দূর না করতে পারলে, একটি যুগোপযোগী কার্যকরী শিক্ষা কমিশন গঠন এবং এর বাস্তবায়ন না করতে পারলে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। সার্বিকভাবে শিক্ষা খাত পুনর্গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা খাত—বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে হবে। তা ছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আরোপিত ট্যাক্স প্রত্যাহার করতে হবে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মূল্যবোধ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক সহিংসতামুক্ত করতে হবে। সর্বোপরি, একটি মানসম্মত, যুগোপযোগী ও কল্যাণকর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠুক-এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট